জুনে ১২ কেজি সিলিন্ডার ৮৪২ টাকা, নজরদারি বাড়ানোর পরামর্শ
ফয়েজ আহমেদ তুষার: রান্নায় ব্যবহৃত এলপি গ্যাসের দাম আরও কমিয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। কমিশনের আদেশ অনুযায়ী, আজ থেকে পুরো জুন মাস ভোক্তারা বেসরকারি প্রতিটি ১২ কেজি সিলিন্ডার সর্বোচ্চ ৮৪২ টাকায় কিনতে পারবেন; যা গত মাসে ছিল ৯০৬ টাকা। সারাদেশের এলপিজি ডিলার, এজেন্ট বা বিক্রেতার জন্য এই সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য কার্যকর হবে। কেউ বেশি দাম চাইলে, আইনত তা হবে দন্ডনীয় অপরাধ। এক্ষেত্রে জেল-জরিমানার বিধান রয়েছে।
তবে নজরদারির অভাবে গত দুই মাস দেশের বিভিন্ন এলাকায় কমিশন ঘোষিত দামের চেয়ে এক-দেড়শ’ টাকা আবার কোথাও দুইশ’ টাকা বেশি দামে এলপি গ্যাস বিক্রি হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। রাজধানীতে অনেকে গ্রাহক নির্ধারিত দামে গ্যাস পাননি। দেশের অন্যান্য জেলা থেকেও এমন অভিযোগ এসেছে। সীমিত অভিযানে কোন কোন এলাকায় দোষীদের শাস্তির আওতায় আনা হলেও এ ধরনের বেশিরভাগ বিক্রেতা রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
জ্বালানি খাতের বিশ্লেষক, ভোক্তা অধিকার সংগঠনের প্রতিনিধি ও সচেতন নাগরিকরা বলছে, ভোক্তা পর্যায়ে কমিশন ঘোষিত দাম নিশ্চিত করতে বিইআরসি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে সমন্বিত উদ্যোগ নিয়ে নজরদারি বাড়াতে হবে বলে মনে করেন।
গ্যাস সংকটের কথা বলে সরকার যখন থেকে আবাসিক খাতে নতুন গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে দেয়, সে সময় থেকে দেশের বাজারে এলপি গ্যাসের চাহিদা বাড়তে শুরু করে। রাজধানীসহ দেশের প্রতিটি জেলায় এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এলপিজির ব্যবহার শুরু হয়। এলপি গ্যাসকে সাশ্রয়ী, সুলভ ও জনপ্রিয় করার আশা দিলেও সরকার তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। সিলিন্ডার সহজে পাওয়া গেলেও সাশ্রয়ী না হওয়ায়, তা জনপ্রিয় হয়নি।
সরকারি খাতে উৎপাদন সীমিত থাকায়, বাজার দখল করে নেয় বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীরা। বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে ১২ কেজি প্রতিটি সিলিন্ডারের দাম এক হাজার ৮শ’ থেকে বৃদ্ধি করে স্থান-কাল ভেদে দুই হাজার ২শ’ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা হয়। এলপিজির বাজারে এই অস্থির পরিস্থিতির কারণে গ্রাহক পর্যায়ে অসন্তোষ বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে উচ্চ আদালত এলপিজির মূল্য নির্ধারণে সংশ্লিষ্টদের আদেশ দেন। যা আমলে নিয়ে বিইআরসি গণশুনানির মাধ্যমে এলপিজির মূল্য সমন্বয়ের উদ্যোগ নেয়। এখন প্রতিমাসেই এলপিজির দাম নির্ধারণ করে দিচ্ছে বিইআরসি।
এশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দাম নির্ভর করে ‘সৌদি আরামকো’ কর্তৃক নির্ধারিত দামের ওপর। সৌদি আরবের এ তেল কোম্পানি প্রতিমাসে এলজিপির একটি দাম ঘোষণা করে। গত ১২ এপ্রিল প্রথমবারের মতো দেশে এলপিজির দাম নির্ধারণের পর মাসে মাসে ‘সৌদি আরমকো’র কন্ট্রাক্ট প্রাইসের ওপর ভিত্তি করে দাম পুনর্নির্ধারণের সিদ্ধান্ত হয়। সে অনুযায়ী এ নিয়ে দুইবার দাম পুনর্নির্ধারণ করা হলো। দুইবারই ধাপে ধাপে দাম কমে এসেছে।
এপ্রিলে ১২ কেজি বেসরকারি এলপি গ্যাসের দাম ৯৭৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। মে মাসে এলপিজির ১২ কেজির সিলিন্ডারের সর্বোচ্চ মূল্য নির্ধারণ করা হয় ৯০৬ টাকা। এবার জুন মাসের জন্য প্রতিটি ১২ কেজি সিলিন্ডারে ৬৪ টাকা কমিয়ে ৮৪২ টাকা নির্ধারণ করা হলো।
ভোক্তা পর্যায়ে জুন মাসের জন্য প্রতিকেজি এলপিজির দাম ঠিক হয়েছে মূসক ছাড়া ৬৫ টাকা ৭২ পয়সা, যা মূসকসহ ৭০ টাকা ১৭ পয়সা পড়বে। সে অনুযায়ী ১২ কেজি, ১৮ কেজি, ২০ কেজি, ২৫ কেজি, ৩০ কেজি বা অন্য ওজনের সিলিন্ডারগুলোর দাম ঠিক হবে।
গতকাল সোমবার এক ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে জুন মাসের জন্য এলপিজির নতুন দাম ঘোষণা করে বিইআরসি। কমিশনের চেয়ারম্যান মো. আব্দুল জলিলের সভাপতিত্বে মূল্য ঘোষণা অনুষ্ঠানে যুক্ত ছিলেন বিইআরসির সদস্য মো. মকবুল-ই-ইলাহী চৌধুরী, মোহাম্মদ আবু ফারুক ও মোহাম্মদ বজলুর রহমান, সচিব রুবিনা ফেরদৌসী, উপ-পরিচালক কামরুজ্জামান প্রমুখ।
বিইআরসি চেয়ারম্যান মো. আব্দুল জলিল গতকাল ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে দাম কমানোর কারণ ব্যাখ্যা করে বলেন, মে মাসের কন্ট্রাক্ট প্রাইসের ভিত্তিতে জুন মাসের বাজার মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। মে মাসে সৌদি আরামকোর প্রোপেনের দাম প্রতি মেট্রিক টন ৪৯৫ ডলার এবং বিউটেন প্রতি মেট্রিক টন ৪৭৫ ডলার ছিল। ৩৫ অনুপাত ৬৫ হিসাবে প্রোপেন ও বিউটেনের মিশ্রণ করার পর গড় মূল্য দাঁড়ায় প্রতি টন ৪৮২ দশমিক ৫০ ডলার, যা এপ্রিল মাসের তুলনায় ৫৮ দশমিক ৫০ ডলার কম। সেই বিবেচনায় দেশের বাজারের জন্য জুন মাসের নতুন দাম ঠিক করা হয়েছে।
পাশাপাশি মে মাসে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ছিল ৮৪ টাকা ৯৫ পয়সা। ক্রয় মূল্য কমে যাওয়ায় তা ভ্যাটকেও কিছুটা প্রভাবিত করেছে, সেটাও বিবেচনা করেছে বিইআরসি। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাসাবাড়িতে কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত (রেটিকুলেটেড পদ্ধতি) এলপিজির দাম প্রতি লিটার ৬৩ টাকা ৪৭ পয়সা (মূসকসহ ৬৭ টাকা ৮৭ পয়সা) ধরা হয়েছে। মে মাসে এই দর ছিল ৭৩ টাকা ২০ পয়সা। অটোগ্যাসের দাম ভোক্তা পর্যায়ে ৪১ টাকা ৭৪ পয়সা ঠিক করা হয়েছে জুন মাসের জন্য, যা মে মাসে ছিল প্রতিলিটার ৪৪ টাকা ৭০ পয়সা।
সম্প্রতি মাসে মাসে মূল্য নির্ধারণে বিইআরসির উদ্যোগ এলপিজির বাজার নিয়ন্ত্রণে কিছুটা হলেও ভূমিকা রাখছে বলে মনে করেন ভোক্তাদের অনেকে। তাদের মতেও কমিশন ঘোষিত মূল্যে যাতে গ্রাহক এলপিজি পায়, সে বিষয়টি কঠোর নজরদারিতে রাখা প্রয়োজন।
বিইআরসির সদস্য (গ্যাস) মো. মকবুল-ই-ইলাহী চৌধুরী সংবাদকে বলেন, ‘এককভাবে কমিশনের এলপিজি’র মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। এটি বাস্তবায়ন করতে সময় লাগবে। গণমাধ্যম, ভোক্তা অধিকার সংস্থা, রাজনৈতিক দল ও সরকারি সংস্থাগুলোর পারস্পরিক সহযোগিতায় এটি করা সম্ভব। কমিশন চিঠি দিয়ে সরকারের সহযোগিতা চেয়েছে। এ ক্ষেত্রে গ্রাহকদেরও সচেতন হতে হবে। অন্যান্য পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে রিটেইল প্রাইস (সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য) দেখে দোকানির সঙ্গে দর-দাম করা গেলে, এলপি গ্যাসের ক্ষেত্রেও সরকার নির্ধারিত মূল্যে ক্রয়ের চেষ্টা করতে হবে।’
গ্রাহকদের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কোথাও নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি রাখা হলে, কমিশনকে লিখিতভাবে জানালে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের তথ্যানুযায়ী, দেশে বসুন্ধরা, যমুনা, ওরিয়ন, বেক্সিমকো, ওমেরা, টোটালগ্যাজসহ ২৮টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এলপিজি খাতে ব্যবসা করছে। দেশে বার্ষিক এলপিজি ব্যবহারের পরিমাণ এক মিলিয়ন টন যার ৯৮ শতাংশ আসে বেসরকারি খাত থেকে। সরকারি কোম্পানি এলপি গ্যাস লিমিটেড (এলপিজিএল) চাহিদার মাত্র দুই শতাংশ সরবরাহ করতে সক্ষম।
এদিকে লোয়াবের (এলপিজি অপারেটস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ) অভিযোগ বিইআরসির দর নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় অনেক খাতের খরচকে বিবেচনায় আনা হয়নি। তাই কমিশন নির্ধারিত মূল্যে এলপিজি বিক্রি করলে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তবে বিইআরসির দাবি, এলপিজি প্রাইসিংয়ে লোয়াব যে ইন্ডিকেটর ব্যবহার করেছে; কমিশনও সেই ইন্ডিকেটর ব্যবহার করে মূল্য নির্ধারণ করেছে।