জিটুজিতে জ্বালানি তেল আমদানি
হাসনাইন ইমতিয়াজ: জিটুজি (সরকার থেকে সরকার) চুক্তিতে ৮টি আন্তর্জাতিক কোম্পানি থেকে চাহিদার অর্ধেক জ্বালানি তেল আমদানি করে বাংলাদেশ। এই দ্বিপক্ষীয় চুক্তির কিছু দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলো। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশ। কারণ, আমদানি ব্যয় বেশি হচ্ছে। তাই চুক্তিপত্র সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন-বিপিসি। সংস্থাটি এ বিষয়ে জ্বালানি বিভাগে পত্র দিয়েছে।
বিপিসির চিঠির সূত্রে জানা গেছে, জিটুজি চুক্তিতে সংশ্নিষ্ট কোম্পানি কোন বন্দর বা দেশ থেকে তেল সরবরাহ করতে হবে চুক্তিপত্রে এমন কোনো শর্ত নেই। ফলে কোম্পানিগুলো নিজেদের সুবিধামতো যেকোনো বন্দর বা দেশ থেকে তেল সরবরাহ করে। এতে তেল আমদানির প্রিমিয়াম বেশি হয়। সব দেশের তেলের মান সমান না হওয়ায় তেলের মানও প্রশ্নবিদ্ধ।
জানা গেছে, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জ্বালানি তেলের বাজার দুটি- সিঙ্গাপুর আর যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশ সিঙ্গাপুরের বাজার থেকে তেল কেনে। বিপিসি দুই পদ্ধতিতে পরিশোধিত ও অপরিশোধিত তেল (ক্রুড অয়েল) আমদানি করে। এগুলো হলো- জিটুজি ও আন্তর্জাতিক দরপত্র। দেশে বছরে জ্বালানি তেলের চাহিদা ৫৫ থেকে ৬০ লাখ টন। ২০১৬ সাল থেকে বিপিসি আমদানি তেলের ৫০ শতাংশ জিটুজি এবং বাকি অর্ধেক উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে সংগ্রহ করে। এর মধ্যে অপরিশোধিত তেল পুরোটা (১৫ লাখ টন) সৌদি আরব ও আবুধাবি থেকে জিটুজি ভিত্তিতে আমদানি করা হয়। জিটুজি ভিত্তিতে পরিশোধিত তেল কেনা হয় সাতটি দেশের আটটি কোম্পানির কাছ থেকে। এগুলো হলো- থাইল্যান্ডের পিটিটি ইন্টারন্যাশনাল, কুয়েত পেট্রোলিয়াম করপোরেশন, চীনের ইউনিপ্যাক (সিঙ্গাপুর), ইন্দোনেশিয়ার পিটি ভুমি সিয়াক পুসাকো জাপিন (বিএসপি), আরব আমিরাতের এমিরেটস ন্যাশনাল অয়েল কোম্পানি (ইএনওসি-সিঙ্গাপুর), মালয়েশিয়ার প্যাটকো ট্রেডিং লাবুয়ান কোম্পানি (পিটিএলসিএল), চীনের পেট্রোচায়না (সিঙ্গাপুর) এবং ভারতের নুমালিগড় রিফাইনারি। আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে বছরে দু’বার তেল কেনা হয়।
যে পদ্ধতিতেই তেল কেনা হোক দাম নির্ধারিত হয় গড় করে। যেদিন বাংলাদেশের জন্য জাহাজে তেল লোড করা হবে তার দুই দিন আগের দাম, সেই দিনের দাম ও তার পরের দুই দিনের দামের (সিঙ্গাপুরভিত্তিক অর্থ-বাণিজ্যবিষয়ক পত্রিকা প্ল্যাটস-এ প্রকাশিত) গড় করে তেলের দাম ঠিক করা হয়। জিটুজি বা দরপত্র যে পদ্ধতিতে তেল কেনা হোক এই দাম একই থাকে। পার্থক্য হয় মূলত প্রিমিয়াম নিয়ে। প্রিমিয়াম হলো জাহাজভাড়া, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ট্যাক্স, ভ্যাট, ইন্স্যুরেন্স ইত্যাদি।
বিপিসির সূত্র জানিয়েছে, জিটুজি পদ্ধতিতে প্রিমিয়াম বেশি পড়ে। দরপত্রে প্রিমিয়াম অনেক কম। বিপিসি বর্তমানে জিটুজিতে প্রিমিয়াম ব্যারেলপ্রতি ৪ দশমিক ৬০ ডলারের ওপরে পরিশোধ করছে। দরপত্রে প্রিমিয়াম ২ দশমিক ৩০ ডলারের মতো।
বিপিসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, জিটুজি ভিত্তিতে ২০১৬ সাল থেকে তেল কেনা হচ্ছে। প্রতি বছর এই চুক্তি নবায়ন করা হয়। এ চুক্তিপত্রে শিপমেন্ট ধারায় কোন দেশ বা কোন বন্দর থেকে তেল সরবরাহ করতে হবে তা উল্লেখ নেই। ফলে চুক্তিবদ্ধ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী যেকোনো দেশ বা বন্দর থেকে তেল নিয়ে আসছে। অধিকাংশ সময় বন্দরের দূরত্ব অনুসারে প্রিমিয়াম নির্ধারণ বেশি হচ্ছে।
বিদ্যমান চুক্তিতে এসব সরবরাহকারীর নিজস্ব তেল শোধনাগার বাধ্যতামূলক হলেও নিজ দেশ থেকে পণ্য সরবরাহের বিষয়টি উল্লেখ নেই। এতে জিটুজির চুক্তির উদ্দেশ্য ও মৌলিক ভিত্তি প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। কারণ, যেসব দেশের তেলের মান ভালো সেসব দেশের রাষ্ট্রীয় কোম্পানির সঙ্গে জিটুজি চুক্তি করা হয়েছে। কিন্তু কোম্পানিগুলো মানসম্মত তেলের পরিবর্তে অনেক সময় ভারত বা চীন থেকে তেল নিয়ে আসছে। সব দেশের তেলের মান সমান না হওয়ায় অনেক সময় নিম্নমানের তেল দেশে ঢুকছে। এছাড়া চুক্তি জিটুজি হলেও অনেক প্রতিষ্ঠান বেসরকারি হিসেবে নিজেদের উল্লেখ করেছে, যা চুক্তির লঙ্ঘন। তাই ২০১৬ সালে সম্পাদিত জিটুজি চুক্তিগুলো পর্যালোচনার জন্য জ্বালানি বিভাগের অনুশাসন চেয়েছে বিপিসি। যাতে চুক্তিবদ্ধ কোম্পানিগুলো নিজ দেশ ছাড়া অন্য দেশ থেকে তেল সরবরাহ করতে না পারে।
বিপিসির একজন পরিচালক জানিয়েছেন, এসব চুক্তি নিয়ে প্রতি বছর কোম্পানিগুলোর সঙ্গে দর কষাকষি হয়। এতে মূলত প্রিমিয়াম নিয়ে আলোচনা হয়। আগে সিঙ্গাপুরে এই বৈঠক হতো। গত বছর কভিডের কারণে ভার্চুয়ালি বৈঠক হয়েছে। এ বছরও ভার্চুয়াল বৈঠক হবে। আগামী ২২ মে থেকে ২৭-২৮ মে পর্যন্ত এই বৈঠক চলতে পারে। তার আগে সরকারের নির্দেশনা প্রয়োজন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জ্বালানি সচিব আনিছুর রহমান কোনো মন্তব্য করতে চাননি। অন্যদিকে বিপিসি চেয়ারম্যান আবু বকর ছিদ্দীক বলেন, এটি সরকারের উচ্চ পর্যায়ের বিবেচনার বিষয়, তার নিজস্ব কোনো মন্তব্য নেই। তবে জ্বালানি বিভাগের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, চাইলেই রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের চুক্তিগুলো সংশোধন করা যায় না। এমন উদ্যোগ নিতে গেলে জ্বালানি তেল আমদানি ব্যাহত হতে পারে। তাই এ বিষয়টি নিয়ে এখনই কোনো আলোচনা হচ্ছে না।
ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম এ বিষয়ে বলেন, জ্বালানি তেল আমদানির পুরো প্রক্রিয়াই অস্বচ্ছ। জ্বালানি খাতের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) এই খাতে কোনো প্রভাব নেই।