- কয়লা তেল গ্যাসের বদলে ব্যবহার করা হবে বায়ু ও সৌরশক্তি
- ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের ৮৪ ভাগ বিদ্যুত আসবে এই খাতে
- দেশে এই খাতে ৩০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন হবে
রশিদ মামুন ॥ বাংলাদেশসহ সারাবিশ্ব বিদ্যুত উৎপাদনে পরিবেশবান্ধব নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের দিকে যাচ্ছে। দ্রুত বদলে যাচ্ছে বিদ্যুত উৎপাদনের চিত্র। কয়লা, তেল-গ্যাস এবং পারমাণবিক বিদ্যুতের স্থান দখল করে নিচ্ছে সোলার এবং বায়ুবিদ্যুত কেন্দ্র। ইন্টারন্যাশনাল রিনিউয়েবল এনার্জি এজেন্সি (আইআরইএনএ) বলছে ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের মোট বিদ্যুত উৎপাদনের ৮৪ ভাগ আসবে সোলার এবং বায়ু থেকে। উন্নত দেশগুলোর পাশাপাশি উন্নয়নশীল দেশগুলোও বিদ্যুত উৎপাদনে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে। সারাবিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশে ২০৪১ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ৩০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদনের পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে দেশে ভবিষ্যত বিদ্যুত উৎপাদনে জ্বালানি সংমিশ্রণ নিয়ে নতুন চিন্তা করা হচ্ছে। বিশ্বের মোট বিদ্যুত উৎপাদনের একটি বড় অংশই আসে কয়লা থেকে। কিন্তু ভবিষ্যত পৃথিবীর পরিবেশ দূষণের কথা চিন্তা করে কয়লার ব্যবহার বন্ধ করে দিচ্ছে অনেক দেশ। কয়লায় পরিবেশ দূষণের সঙ্গে খনি উন্নয়ন করতে গিয়ে ব্যাপক আবাদি জমি বিনষ্ট হয়। সারাবিশ্বের এই নীতির সঙ্গে বাংলাদেশও কয়লা থেকে সরে আসার পরিকল্পনা করছে। পায়রা-১৩২০ মেগাওয়াটের দ্বিতীয় ইউনিট বিদ্যুত কেন্দ্রটি হবে দেশের শেষ কয়লা চালিত বিদ্যুত কেন্দ্র। ইতোমধ্যে পরিকল্পনায় থাকা সকল কয়লাচালিত বিদ্যুত কেন্দ্র বাতিল করার বিষয়ে একটি সুপারিশ প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য পাঠিয়েছে বিদ্যুত বিভাগ।
কয়লাচালিত বিদ্যুত কেন্দ্র থেকে সরকার কেন সরে আসছে সে সম্পর্কে বিদ্যুত বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, এখন নতুন করে কোন বিনিয়োগকারী কয়লা বিদ্যুতে বিনিয়োগ করতে চাইছে না। অন্যদিকে বিশ্বে কয়লার উত্তোলন দিন দিন কমিয়ে আনার পরিকল্পনা করছে দেশগুলো। এই দুই কারণে ভবিষ্যতে কয়লাচালিত বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করলে তা ঝুঁকি বাড়াবে। সঙ্গত কারণে এখনই পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনা হচ্ছে।
অন্যদিকে গ্যাস এবং তেল দিয়ে বিদ্যুত উৎপাদন ব্যয়বহুল। এছাড়া বিশ্বে গ্যাস এবং তেলের অফুরন্ত মজুদ নেই। যার কারণে বিদ্যুত উৎপাদনের বিকল্প জ্বালানি ব্যবহারের চিন্তা করা হচ্ছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিদ্যুত উৎপাদনে জ্বালানি খরচ শূন্য এবং জ্বালানির মজুদ শেষ হওয়া নিয়ে কোন শঙ্কা নেই। দিন দিন নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিদ্যুত উৎপাদনে গবেষণা বিস্তৃত হচ্ছে। ইতোমধ্যে সৌর এবং বায়ু বিদ্যুতের দক্ষতা বাড়ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিদ্যুত উৎপাদনের সবচাইতে বড় সমস্যা হচ্ছে জমির প্রাপ্যতা। বিশেষ করে এক মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুত উৎপাদনের জন্য সাড়ে তিন একর জমির প্রয়োজন হয়। এই জমি দীর্ঘ সময় আটকে রাখায় ফসল উৎপাদন করা যায় না। কিন্তু এখন সারাবিশ্বে জমির বহুমুখী ব্যবহার করে সৌর বিদ্যুত উৎপাদন করা হচ্ছে। সৌর বিদ্যুতের নিচে ফসল উৎপাদন করা হচ্ছে। একইসঙ্গে বিদ্যুত কেন্দ্রের নিচে হাঁস, মাছ চাষ করা হচ্ছে। ফলে জমি ব্যবহার করলে কৃষি আবাদ করা যাবে না এমন ধারণা থেকে ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশ বের হয়ে এসেছে।
নবায়নযোগ্য জ্বালানির ক্ষেত্রে প্রকৃতির খেয়ালি আচরণের ওপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু ব্যয়বহুল হলেও এলন মাস্ক অস্ট্রেলিয়াতে বিশ্বের সবথেকে বড় ব্যাটারিতে বিদ্যুত ধরে রাখার কৌশল দেখিয়েছেন। মাস্কের টেসলারের এই সফলতা বলছে লিথিয়াম আয়োন ব্যাটারির প্রযুক্তি আরও উন্নত হলে এটি কোন সমস্যাই হবে না। টেসলারের মতো বড় না হলেও দেশে সোলার মিনিগ্রিড দিয়ে বিদ্যুত সরবরাহ হচ্ছে দুর্গম চর এলাকাতে। তবে বিদ্যুত উৎপাদনের আধুনিক প্রযুক্তি সমন্বয় ঘটানো গেলে এটি আরও বিস্তৃত করা সম্ভব। যাতে সার্বক্ষণিক এই উৎসের বিদ্যুত সরবরাহ পাওয়া যাবে।
আইআরইএনএ সূত্র বলছে ২০৫০ সালের মধ্যে সোলার থেকে বিশ্বের মোট বিদ্যুত উৎপাদনের পরিমাণ হবে ৩৫ দশমিক আট ভাগ। হাইড্রো বা জল থেকে ১২ দশমিক ৪ ভাগ, স্থলভাগের বায়ু থেকে ২৪ দশমিক ৩ ভাগ এবং সাগরের বায়ু থেকে আরও ১২ দশমিক একভাগ বিদ্যুত পাওয়া যাবে। ইতোমধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সাগরের মধ্যে উইন্ড মিল বসিয়ে বিদ্যুত উৎপাদন করে সাবমেরিন ক্যাবল দিয়ে গ্রিডে যোগ করছে। দশেরও উপকূলের বিরাট অংশজুড়ে বায়ু বিদ্যুতের সম্ভাবনা রয়েছে। কেবল দেশের এই এলাকায় ১০ হাজার মেগাওয়াট বায়ু বিদ্যুত উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু এখন সেখান থেকে এক মেগাওয়াটেরও কম বিদ্যুত উৎপাদন হয়।
এখন দেশে ৫৪৬ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুত উৎপাদন হচ্ছে। আগামী ২০২১ থেকে ২০৪১ পর্যন্ত দেশে ২০ হাজার ৭১১ মেগাওয়াট এবং ২০৩১ থেকে ২০৪১ পর্যন্ত ২০ হাজার ৭১১ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুত উৎপাদনের পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। অর্থাৎ ২০৪১ সালে গিয়ে দেশে মোট ৩০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত আসবে সৌর বিদ্যুত থেকে। সরকারের টেকসই নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (স্রেডা) সম্প্রতি এই পরিকল্পনায় বিদ্যুত বিভাগের অনুমোদন নিয়েছে।
পিডিবি সূত্র জানায়, আমেরিকার ন্যাশনাল রিনিউয়েবল এনার্জি ল্যাবরেটরি (এনআরইএল) গত বছর বায়ু প্রবাহের রেকর্ড পর্যবেক্ষণ করে দেশের কিছু এলাকাকে বিদ্যুত উৎপাদনের উপযুক্ত বলে জানিয়েছে। এনআরইএল এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল বাংলাদেশে ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে।
প্রতিবেশী দেশ ভারতও তাদের দেশে ৩২ হাজার মেগাওয়াট বায়ু বিদ্যুত উৎপাদনের প্রকল্প গ্রহণ করেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন বাংলাদেশে এক হাজার ২০০ কিলোমিটার উপকূলীয় এলাকা রয়েছে সেখানে বায়ু বিদ্যুত উৎপাদনের ব্যাপক সম্ভবনা থাকলেও কাজে লাগানো যাচ্ছে না।
আগে একটি টারবাইন থেকে কয়েক কিলোওয়াট বিদ্যুত পাওয়া গেলেও এখন এক মেগাওয়াট থেকে ৬ মেগাওয়াটের উইন্ড মিল রয়েছে। ফলে ১০টি উইন্ড মিল বসিয়েও ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন সম্ভব। এর সব থেকে বড় সুবিধা হচ্ছে এখানে সৌর বিদ্যুতের মতো বড় জমি প্রয়োজন হয় না। আবার যেখানে উইন্ড মিল বসানো হয় তার নিচের জমি ব্যবহার করা যায়।
সরকার বলছে ২০৪১ সালে দেশ উন্নত দেশে পরিণত হবে। তখন দেশের মোট বিদ্যুত উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬০ হাজার মেগাওয়াট। এর অর্ধেকের বেশি আসবে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে। সরকার নতুন করে পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যান প্রণয়ন করতে যাচ্ছে। এবার পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যানে প্রাথমিক জ্বালানিকে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। অর্থাৎ এবার পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যানে জ্বালানির উৎস চিহ্নিত করলে সৌর, বায়ু এবং অন্যান্য জ্বালানিতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এক্ষেত্রে নবায়নযোগ্য উৎসের বিদ্যুত উৎপাদনের পরিমাণ নির্দিষ্ট হবে।