৭ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা পাওনা ছয় বিতরণ সংস্থার সরকারি প্রতিষ্ঠান সাড়ে ছয় মাস, আধাসরকারিগুলো পৌনে ছয় মাস এবং স্থানীয় সরকার পৌনে ১৭ মাসের বিল বকেয়া রেখেছে সাধারণ ও বেসরকারি খাতে বকেয়া পৌনে দুই মাসের
মাহবুব রনি: দেশে দীর্ঘ সময় ধরে বিদ্যুত্ বিল বকেয়া রাখছে সরকারি, আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলো। সাধারণ ও বেসরকারি খাতের গ্রাহকরা গড়ে পৌনে দুই মাসের বিল বাকি রাখছেন। অথচ সরকারি, আধাসরকারি ও স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলো পর্যায়ক্রমে প্রায় সাড়ে ছয় মাস, পৌনে ছয় মাস এবং পৌনে ১৭ মাসের বিল বকেয়া রয়েছে। বিদ্যুত্ বিল আদায়ের সামগ্রিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারছে না বিতরণ সংস্থাগুলো। সময়মতো বিল পরিশোধে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর এ ‘অনীহার’ কারণে গ্রাহক সেবার মান বৃদ্ধি এবং উন্নয়ন কার্যক্রমে গতি সৃষ্টি করতে পারছে না বিদ্যুত্ বিতরণে নিয়োজিত বোর্ড-কোম্পানিগুলো।
দেশে বর্তমানে ছয়টি সরকারি প্রতিষ্ঠান বিদ্যুত্ বিতরণ করছে। গত নভেম্বর পর্যন্ত এ কোম্পানিগুলোর এবং বিদ্যুত্ বিভাগের হাল নাগাদকৃত তথ্য অনুযায়ী, সব মিলিয়ে ৭ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা বিদ্যুত্ বিল বকেয়া রয়েছে। টাকার অঙ্কে বেসরকারি খাতে বকেয়া বিলের পরিমাণ বেশি হলেও সময়ের হিসাবে সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বাকির খাতা বেশ দীর্ঘ। মোট ৭ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা বকেয়ার মধ্যে বেসরকারি খাতের বকেয়ার পরিমাণই ৬ হাজার ৩২৩ কোটি টাকা। বাকি প্রায় ১ হাজার ৫১৭ কোটি টাকা বকেয়া রেখেছে সরকারি ও আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো।
বিদ্যুত্ বিল বকেয়া পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে তিনটি পৃথক বিতরণ কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা বলেন, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট বকেয়ার পরিমাণ বেশি হলেও তারা অপেক্ষাকৃত কম সময় সে বকেয়া ধরে রাখছে। প্রকৃতপক্ষে এখন বেসরকারি খাতে বিলিং মাসের বাইরে এক সমতুল্য মাসের কম সময়ের বিল বাকি রয়েছে। ফলে এটি বিতরণ কোম্পানিগুলোর ওপর বেশি চাপ তৈরি করছে না। কিন্তু অনেক সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কয়েক বছর ধরেও বিল দিচ্ছে না। এটি বাড়তি চাপ তৈরি করছে।
বিদ্যুত্ বিভাগের থিঙ্ক ট্যাংক প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, দেশের বিদ্যুত্ খাতের অগ্রগতির পথে একটি বড় বাধা বকেয়া বিল। স্মার্ট ও প্রিপেইড মিটার পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা গেলে বকেয়া নিয়ে অস্বস্তি চাপ দূর হয়ে যাবে। বিতরণ ব্যবস্থা উন্নয়ন ও প্রিপেইড মিটার স্থাপনে অনেকগুলো প্রকল্প চলমান রয়েছে। তিনি বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যেন দ্রুত বিল পরিশোধ করে তার জন্য যোগাযোগ করা হয়েছে। পরিস্থিতি আগের চেয়ে ভালো হয়েছে। তবে আরো ভালো হওয়া প্রয়োজন।
দেশে বিদ্যুত্ বিতরণকারী ছয়টি প্রতিষ্ঠান হলো—বাংলাদেশ বিদ্যুত্ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি), বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি), ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি), ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো), ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো) এবং নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো)।
মাসের হিসেবে বকেয়াস
রকারি, আধাসরকারি, স্থানীয় সরকার এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বকেয়া বিল বাবদ পিডিবি যথাক্রমে ৭.১৪ মাসের, ৬.৯৩ মাসের, ১৮.০১ মাসের এবং ২.৪৭ মাসের সমতুল্য বিল পাবে। পল্লী বিদ্যুত্ সরকারি ও আধাসরকারি থেকে পাবে ৩.০৭ এবং ২.১৩ মাসের বিল। সবচেয়ে বড় এ বিতরণ সংস্থা স্থানীয় সরকার থেকে বকেয়া বিল বাবদ পাবে ১০.২৯ মাসের বিল। বেসরকারি খাত থেকে পাওনা রয়েছে ১.৬৪ মাসের বিল। স্থানীয় সরকারের সংস্থাগুলোর মধ্যে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদের মতো প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
ডিপিডিসি সরকারি, আধাসরকারি, স্থানীয় সরকার এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বকেয়া অর্থ বাবদ যথাক্রমে পাবে ৯.২০, ৩.৭২, ৭.৩০ এবং ১.৪২ সমতুল্য মাসের বিল। ডেসকো সরকারি, আধাসরকারি, স্থানীয় সরকার এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে পাওনা রয়েছে যথাক্রমে ৭.০৭, ০.৬৯, ২.৭০ এবং ১.৪৯ মাসের বিল।
সরকারি, আধা সরকারি, স্থানীয় সরকার এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বকেয়া অর্থ বাবদ ওজোপাডিকো যথাক্রমে ৩.১৮, ১০.১৭, ৪৮.১১ এবং ১.২৩ মাসের সমতুল্য বিল পাবে। নেসকো সরকারি, আধা সরকারি, স্থানীয় সরকার এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বকেয়া অর্থ বাবদ যথাক্রমে পাবে ১১.২৯, ২.৭১, ১৭.৫৩ এবং ১.৬১ মাসের বিল। সরকারি, আধা সরকারি, স্থানীয় সরকার এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে সবগুলো সংস্থার মোট বকেয়ার পরিমাণ যথাক্রমে ৬.৭৫, ৪.০২, ১০.৮৫ এবং ১.৭১ সমতুল্য মাসের বিল।
টাকার অঙ্কে বকেয়া
সরকারি, আধা সরকারি, স্থানীয় সরকার এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বকেয়া বিল বাবদ পিডিবি পাবে যথাক্রমে ১ হাজার ৯৪০ মিলিয়ন টাকা, ৭৯৮ দশমিক ৩৮ মিলিয়ন টাকা, ৭৪৯ মিলিয়ন টাকা এবং ১৪ হাজার ৩১১ মিলিয়ন টাকা। পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড সরকারি, আধা সরকারি, স্থানীয় সরকার এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বকেয়া অর্থ বাবদ যথাক্রমে পাবে ৭৪৯ দশমিক ৯২ মিলিয়ন টাকা, ১৮৯.৭৯ মিলিয়ন টাকা, ২৮৭.৬৪ মিলিয়ন টাকা এবং ৩২ হাজার ১৩২ মিলিয়ন টাকা।
সরকারি, আধা সরকারি, স্থানীয় সরকার এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বকেয়া বিল বাবদ ডিপিডিসি পাবে যথাক্রমে ১ হাজার ৪১৯ মিলিয়ন টাকা, ৩০৫ দশমিক ৭৯ মিলিয়ন টাকা, ১৫১০ মিলিয়ন টাকা এবং ৭ হাজার ২৮৮ মিলিয়ন টাকা। ডেসকো সরকারি, আধা সরকারি, স্থানীয় সরকার এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বকেয়া অর্থ বাবদ যথাক্রমে পাবে ১ হাজার ২৯৮ মিলিয়ন টাকা, ৩৯.২৭ মিলিয়ন টাকা, ৪০০.৬৭ মিলিয়ন টাকা এবং ৪ হাজার ৫৪৪ মিলিয়ন টাকা। ওজোপাডিকো এবং নেসকোর মোট বকেয়া বিলের পরিমাণ যথাক্রমে ৪ হাজার ৩৩ মিলিয়ন টাকা এবং ৬ হাজার ৪০৯ মিলিয়ন টাকা। সরকারি, আধা সরকারি, স্থানীয় সরকার এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে সবগুলো সংস্থার মোট বকেয়ার পরিমাণ পর্যায়ক্রমে ৭ হাজার ৩৪১ মিলিয়ন টাকা, ১ হাজার ৮৬৭ মিলিয়ন টাকা, ৫ হাজার ৯৬১ মিলিয়ন টাকা এবং ৬৩ হাজার ২৩৬ মিলিয়ন টাকা।
বিদ্যুত্ বিভাগ সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকারি ও আধা সরকারি খাতের বকেয়া বিল কমানোর বিষয়ে সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ নেওয়া হয় ২০১৭ ও ২০১৮ সালে। ২০১৭ সালে তখনকার বিদ্যুত্ সচিব ও বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের মুখ্য সচিব ড. আহমেদ কায়কাউস বলেন, ‘বেসরকারি পর্যায়ে বিদ্যুত্ বিলের বকেয়া তেমন নেই। কিন্তু সরকারি পর্যায়ে অনেক বকেয়া রয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যে বরাদ্দ পায় তাতে বিদ্যুত্ বিল পরিশোধেরও অর্থ রয়েছে। কিন্তু তারা পরিশোধ করছে না।’ পরবর্তীতে সরকারি সংস্থাগুলোর কাছ থেকে বকেয়া বিল আদায়ে মন্ত্রণালয়ভিত্তিক দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নির্ধারণ করে দেয়া, বিল পরিশোধে আধা সরকারি পত্র (ডিও লেটারও) ইস্যু করা এবং টাস্কফোর্সের ঝটিকা অভিযানের ফলে ২০১৮ সালে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বিপুল পরিমান বকেয়া আদায় করা হয়। ফলে ওই বছরের মে মাস পর্যন্ত বাকির খাতায় বেসরকারির চেয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বকেয়া অপেক্ষাকৃত কম ছিল। কিন্তু পরিস্থিতি এখন আবার আগের অবস্থায় ফিরে গেছে।
এ প্রসঙ্গে ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী বিকাশ দেওয়ান এবং ডেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. কাউসার আমির আলী বলেন, সরকারি ও আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানে বিদ্যুত্ বিল পরিশোধে সরকার আলাদা বরাদ্দ দেয়। কিন্তু সে অর্থ তারা অন্য খাতে খরচ করে। এ মনোভাব যত দ্রুত সম্ভব পরিবর্তন করা দরকার। এ খাতে শৃঙ্খলা ও উন্নয়ন প্রতিষ্ঠায় এটি খুব জরুরি।