আরিফুজ্জামান তুহিন: দিনাজপুরের নবাবগঞ্জের দিঘিপাড়ায় কম আর্দ্রতা ও কম সালফারের উন্নতমানের কয়লার বড় মজুদের সন্ধান মিলেছে। প্রায় ৩০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে এই কয়লার অস্তিত্ব রয়েছে। সেখানে ভূপৃষ্ঠ থেকে ৩২০ মিটার থেকে ৫০৬ মিটার গভীরতায় ৭০৬ মিলিয়ন টন বা ৭০ কোটি ৬০ লাখ টন কয়লার মজুদ রয়েছে। এর মধ্যে ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ পদ্ধতিতে উত্তোলন করলে ৩০ বছরে ৯ কোটি টন কয়লা উত্তোলন করা যাবে। আর ওই কয়লা দিয়ে একই সময়কালে প্রতিদিন ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। সরকার দ্রুত এ খনি থেকে কয়লা উত্তোলন করতে চায় বলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন।
তবে দেশের জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা দিঘিপাড়া কয়লাখনির এই বিশাল মজুদের কাজে লাগা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, দেশের প্রায় সবগুলো বিদ্যুৎকেন্দ্রই করা হয়েছে উপকূলীয় এলাকায়। কিন্তু তা না করে কয়লাখনির উৎসমুখে বিদ্যুৎকেন্দ্র করা গেলে সাশ্রয়ীমূল্যে বিদ্যুৎ মিলত। একইসঙ্গে কয়লা উত্তোলনের ক্ষেত্রে পরিবেশ সুরক্ষার ব্যাপারেও সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
দিঘিপাড়া কয়লাখনির মজুদ ও তা উত্তোলনের পদ্ধতি নির্ধারণের জন্য ২০১৭ সালের মে মাসে জার্মানির দুটি ও অস্ট্রেলিয়ার একটি কোম্পানি মিলে গঠিত কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে চুক্তি সই হয় সরকারি প্রতিষ্ঠান বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডের (বিসিএমসিএল)। ওই কনসোর্টিয়ামের গত বছর জমা দেওয়া প্রতিবেদনে দিঘিপাড়া কয়লাখনির মজুদ ও তা উত্তোলনের পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়। এই খনির কয়লা উত্তোলনের ক্ষেত্রে দুটি চিন্তা করছে সরকার। এক. বিদেশি ঠিকাদার কোম্পানিকে দিয়ে উত্তোলন করে তাদের কাছ থেকে কয়লা কিনে নেওয়া। দুই. বিদেশি ঠিকাদার কোম্পানি উত্তোলনের পর খনিমুখেই খনির কয়লা দিয়ে এক হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করবে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি কনসোর্টিয়াম সম্ভাব্যতা প্রতিবেদন দিয়েছে। দিঘিপাড়ার কয়লার মান খুবই উন্নত, কম সালফার। সে কারণে পরিবেশের ক্ষতির মাত্রা খুবই কম হবে। কয়লাতে পানি কম ও কয়লার ক্যালোরিফিক ভ্যালু (দাহ্য ক্ষমতা) অনেক বেশি। তবে সবার আগে পরিবেশ রক্ষার বিষয়টি নিয়ে আমরা ভাবছি। পরিবেশ রক্ষা করে খনি করা সম্ভব হলে সেখান থেকে কয়লা উত্তোলন করা হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘কয়লা উত্তোলন করা গেলে হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। কম দামে বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। বিদেশ থেকে কয়লা আমদানির প্রয়োজন হবে না।’
দেশের জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে পাঁচটি কয়লাখনি রয়েছে। এর মধ্যে ফুলবাড়ী, বড়পুকুরিয়া ও দিঘিপাড়া দিনাজপুর জেলায়। আর বাকি দুই খনি হলো জয়পুরহাটের জামালগঞ্জে ও রংপুরের খালাসপীরে। দেশে একমাত্র বড়পুকুরিয়া খনি থেকে কয়লা উত্তোলন করা হচ্ছে। ওই খনির কয়লা দিয়ে পাশেই পিডিবির ৫২৪ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র চলে। দেশে বর্তমানে প্রায় ১৮ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে, যার প্রায় সবগুলো উপকূলীয় এলাকায়। ফলে দেশের কয়লা রেখে বিদেশ থেকে কয়লা আমদানির পথ নিয়েছে সরকার।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. বদরুল ইমাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কয়লাখনির উৎসমুখে বিদ্যুৎকেন্দ্র করা গেলে সাশ্রয়ীমূল্যে বিদ্যুৎ পাওয়া যেত। কিন্তু সবগুলো বিদ্যুৎকেন্দ্র করা হয়েছে উপকূলীয় এলাকায়। এর কারণ হলো কয়লার ব্যবসা যারা করতে চান তাদের স্বার্থ রক্ষা করা। সরকারি ব্যবস্থাপনায় কয়লা উত্তোলন করা হলে সেখানে দেশি ও বিদেশি কমিশনভোগীরা কোনো ভাগ পাবে না।’ একইসঙ্গে কয়লা উত্তোলনের ক্ষেত্রে পরিবেশ সুরক্ষার ব্যাপারেও সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার আহ্বান জানান এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ।
দিঘিপাড়ার কয়লা :
জার্মানির দুই প্রতিষ্ঠান এমআইবিআরএজি কনসালটিং ইন্টারন্যাশনাল ও ফুগরো কনসালট্যান্ট এবং অস্ট্রেলিয়ার প্রতিষ্ঠান রুঞ্জ পিনাক মিনারকো লিমিটেড (জঁহমব চরহধপড়পশ গরহধৎপড়) কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে বিসিএমসিএলের চুক্তি হয় ২০১৭ সালের ৩০ মে। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৮৩ কোটি টাকা।
বিদেশি ওই কনসোর্টিয়ামটির প্রতিবেদনে বলা হয়, দিঘিপাড়ায় ৩০ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় তিনটি কয়লার স্তর পাওয়া গেছে যা ‘কোল সিম’ নামে পরিচিত। এর মধ্যে সিম নম্বর ‘এ’ ৮.৩০ বর্গকিলোমিটার, সিম নম্বর ‘বি’ ১০.৫ বর্গকিলোমিটার ও সিম নম্বর ‘সি’ ১১ বর্গকিলোমিটার। এই কয়লার স্তরের পুরুত্ব যথাক্রমে ১৪.৫৬ মিটার, ৩১.৬৯ মিটার ও ১৫.০৮ মিটার। ভূপৃষ্ঠ থেকে কয়লার গভীরতা ৩২০ মিটার থেকে ৫০৬ মিটারের ভেতর। এই তিনটি স্তরে কয়লার মজুদের পরিমাণ ৭০ কোটি ৬০ লাখ মেট্রিক টন। ভূগর্ভস্থ বা আন্ডারগ্রাউন্ড পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করলে এর মধ্যে ৯ কোটি টন কয়লা উত্তোলন করা যাবে। বিদেশি কনসোর্টিয়াম ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের পরামর্শ দিয়েছে।
তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, দিঘিপাড়া খনির কয়লায় ছাই বা অ্যাশের পরিমাণ প্রতি ইউনিটে ১৪.৬ শতাংশ, এ কয়লায় কার্বন রয়েছে ৫২.৬০ শতাংশ, সালফার রয়েছে দশমিক ৮৫ শতাংশ, আর্দ্রতা বা পানি রয়েছে ২.২ শতাংশ এবং ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট (বিটিইউ) বা দাহ্য ক্ষমতা ১১৯৫২। এই খনির কয়লা উত্তোলন করতে হলে ১৩.৯৮ বর্গকিলোমিটার জায়গার প্রয়োজন হবে। এর মধ্যে প্রায় ১০.২৪ বর্গকিলোমিটার দেবে (সাবসিডেন্স) যেতে পারে। আর খনির শিল্প এলাকা হবে ৩.৭৫ বর্গকিলোমিটার। প্রায় ১৪ কিলোমিটার খনি এলাকার মধ্যে ৮৩ ভাগ জমিতে কৃষিকাজ হয়, বাকি ১৩ ভাগ জমিতে বসতি, ৩ ভাগ এলাকায় জলাধার এবং ১ ভাগ অন্যান্য প্রকৃতির।
কনসোর্টিয়ামের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, খনি থেকে কয়লা তুলতে হলে ২ হাজার ৭৯৮টি পরিবারের ১১ হাজার ১১০ জন মানুষকে পুনর্বাসন করতে হবে। এতে ব্যয় হবে প্রায় ২৬০০ কোটি টাকা। ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে খনিটি থেকে প্রতি বছর গড়ে ২৮ লাখ টন হিসেবে প্রায় ৩০ বছর পর্যন্ত কয়লা উত্তোলন করা সম্ভব হবে। এতে ১ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রাখা যাবে।
প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়, দিঘিপাড়া খনি থেকে কয়লা উত্তোলন করতে ৭ থেকে ৮ বছর সময় প্রয়োজন হবে। এ হিসেবে যদি ২০২১ সালে খনি উন্নয়ন শুরু করা যায় তাহলে ২০২৯ সালে এটি থেকে আংশিক উৎপাদন এবং ২০৩৩ সালে পূর্ণাঙ্গ উৎপাদন শুরু করা সম্ভব হবে।
প্রতিবেদনের আর্থিক বিশ্লেষণে বলা হয়, খনি উন্নয়নে ২.৫৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রয়োজন হবে। এটির উৎপাদন ব্যয় হবে প্রতি টন কয়লার দাম ৩৬.৩০ মার্কিন ডলার। বর্তমানে বড়পুকুরিয়ার কয়লা প্রতি টন পিডিবি কিনছে ১৫০ ডলারে।
উত্তোলনে ঝুঁকিও কম না :
দিঘিপাড়া খনিতে কয়লার স্তরে পানির বড় একটা স্তর রয়েছে। এ পানির সর্বনিম্ন পুরুত্ব ৪০.৫০ মিটার এবং সর্বোচ্চ পুরুত্ব ২২৮.৫০ মিটার পর্যন্ত। এ খনির গড় পানির পুরুত্ব হলো ১৩৪.৮২ মিটার। পানির এই বড় পুরুত্ব রক্ষা করে খনি উন্নয়ন করাই বড় চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, খনি উন্নয়ন করতে হলে প্রতি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১৯,৪৯৪ ঘনমিটার থেকে সর্বনিম্ন ৩,৯৫৩ ঘনমিটার পানি উত্তোলনের প্রয়োজন হবে। এই পানি নিয়ন্ত্রণের জন্য কয়লার চারদিকে পানিকে আটকানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
পরামর্শক কনসোর্টিয়ামের বিশ্লেষণ অনুযায়ী দিঘিপাড়া খনিতে ঠিক কয়লার ওপরে বড় একটি পানির স্তর রয়েছে। ফলে খনির অভ্যন্তরের পানির স্তরের নিচে যেসব এলাকায় ৩০ মিটারের কম শক্ত ভূ-কাঠামো (রুফ রক বলা হয়) রয়েছে সেখান থেকে কয়লা উত্তোলন করা সম্ভব হবে না। এছাড়া খনি এলাকায় একটি নদীর (তুলশি গঙ্গা) কিছু অংশ এবং একটি মহাসড়ক স্থানান্তরিত করতে হবে বলেও প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানি বিষয়ক বিশেষ সহকারী ম. তামিম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকারের এখন নীতি অনুযায়ী কয়লা উত্তোলন না করার নীতি। এই নীতির পরিবর্তন করা না হলে এই দিঘিপাড়া কয়লাখনিতে যত ভালো কয়লাই থাকুক তাতে কোনো লাভ নেই।’
দিঘিপাড়া কয়লা খনিটি বাংলাদেশ ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর (জিএসবি) ১৯৯৫ সালে আবিষ্কার করে।
দেশের পাঁচটি কয়লাখনির মোট কয়লার মজুদ প্রায় ৩০০ কোটি টন। এ পরিমাণ কয়লা প্রায় ৭০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ) গ্যাসের সমান। দেশে এখন পর্যন্ত প্রমাণিত গ্যাসের মজুদ প্রায় ২৭ টিসিএফ, যার ১৪ টিসিএফের বেশি ইতিমধ্যে ব্যবহার করা হয়েছে। বাকি গ্যাস ২০৩০ সালের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। সরকার জ্বালানি খাত নিরাপদ রাখতে ইতিমধ্যে দৈনিক ১০০ কোটি ঘনফুট তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করছে। এ বাবদ বছরে ব্যয় এখন প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা।