লুৎফর রহমান কাকন : সুযোগ না থাকলেও শিল্প গ্রাহকরা পছন্দসই বিতরণ কোম্পানির বিদ্যুৎ সংযোগ চান। বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (বিআরইবি) অধিক্ষেত্রে শিল্পকারখানা গড়ে তুলে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) বিদ্যুৎ সংযোগ পেতে চেষ্টা করছেন অনেক শিল্প গ্রাহক। বিআরইবির এলাকায় থেকেও তিনটি শিল্প প্রতিষ্ঠান পিডিবির বিদ্যুৎ সংযোগ চেয়ে আবেদন করেছে। বিআরইবি বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে পারলেও শিল্প গ্রাহকরা কেন পিডিবির সংযোগ চান- এমন বিতর্কের কারণ খতিয়ে দেখতে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়েছে।
বিতরণ কোম্পানিগুলোর ভৌগোলিক সংকট সমাধানে বিদ্যুৎ বিভাগের চার সদস্যের কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা) রহমত উল্লাহ মো. দস্তগীর, অতিরিক্ত সচিব (বিধি ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি) একেএম হুমায়ন কবীর, পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন, বিদ্যুৎ বিভাগের যুগ্ন সচিব মো. খায়রুল কবীর মেনন।
কমিটি বিদ্যুৎ আইন ২০১৮, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের নির্দেশনা, বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুৎ আইন পর্যালোচনা করে বলেছে- এক বিতরণ কোম্পানির অধিক্ষেত্রে অন্য বিতরণ কোম্পানির বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া আইনসম্মত নয়। তবে ২০১৮ সালের বিদ্যুৎ আইনের এক ধারায় এক লাইসেন্সি কোম্পানিকে আরেক লাইসেন্সি কোম্পানির বিতরণ এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়াকে উৎসাহিত করেছে
দেশে ছয়টি বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি। তাদের বিদ্যুৎ বিতরণ এলাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। ছয়টি বিতরণ কোম্পানি সারাদেশে বিদ্যুৎ সংযোগ পৌঁছে দিয়েছে মানুষকে। তবে শিল্প গ্রাহকদের পছন্দ পিডিবি। বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (বিআরইবির) বিতরণ এলাকায় থেকেও শিল্প গ্রাহকরা পিডিবির বিদ্যুৎ সংযোগ চেয়ে আবেদন করেছে বিদ্যুৎ বিভাগে। অর্থাৎ শিল্প গ্রাহকরা বিদ্যুৎ সংযোগের ক্ষেত্রে পছন্দসই বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির বিদ্যুৎ সংযোগ চান। শুধু শিল্প গ্রাহকই নন, কোনো কোনো এলাকায় বিআরইবির আবাসিক গ্রাহকরাও পিডিবির বিদ্যুৎ সংযোগ চান। কিন্তু কেন? বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন- দীর্ঘ সময় শিল্প গ্রাহকরা পিডিবি থেকে বিদ্যুৎ ব্যবহার করে আসছেন। ১৩২ কেভি লেভেলে পিডিবির সঞ্চালন লাইন বেশি। এ ছাড়া গ্রাহকরা হয়তো পিডিবি থেকে বেশি সুবিধা পাবেন- এমন মানসিকতা থেকেই পিডিবির বিদ্যুৎ সংযোগ চেয়ে আবেদন করছেন।
উল্লেখ্য, পিডিবিতে সিস্টেমলস এবং অনিয়ম অন্যান্য বিতরণ কোম্পানির থেকে বেশি।
তবে এটাও বাস্তবতা- দেশের সব বিতরণ কোম্পানি গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারছে না, অবকাঠামো এবং কারিগরি সক্ষমতার অভাব থাকার কারণে। বিশেষ করে বিতরণ কোম্পানিগুলো শিল্প গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে না পারার কারণে শিল্পকারখানা সব রাজধানী এবং আশপাশের জেলাভিত্তিক গড়ে উঠছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিল্পকারখানা করতে আগ্রহী হলেও চাহিদাকৃত লোডে বিদ্যুৎ সংযোগ না পাওয়ার কারণে সংকটে পড়ছেন শিল্পমালিকরা। ফলে এক বিতরণ কোম্পানির আওতায় থেকেও অন্য বিতরণ কোম্পানির বিদ্যুৎ সংযোগ চেয়ে আবেদন করছেন গ্রাহকরা, যার কারণে কমিটি বিতরণ কোম্পানিগুলো অবকাঠামোগত এবং কারিগরি ও আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য জোর দিয়েছে।
এদিকে আইনগতভাবে আবার এক বিতরণ কোম্পানির এলাকায় অন্য বিতরণ কোম্পানি বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে পারে না। ফলে বিতরণ কোম্পানিগুলোর ভৌগলিক সীমানা নিয়ে অনেক দিন যাবৎ সংকট চলে আসছে নিজেদের মধ্যে।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানাযায়, সম্প্রতি তিনটি বেসরকারি কোম্পানি তাদের শিল্পকারখানার জন্য বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের কাছে আবেদন করে। তবে শিল্পকারখানাগুলো বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (বিআরইবি) আওতাধীন বিতরণ এলাকায়। বেসরকারি তিনটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড, সেভেন সার্কেল বাংলাদেশ লিমটেড এবং তাসমিন কেমিক্যাল কমপ্লেক্স লিমিটেড। প্রতিষ্ঠান তিনটি ১৩২ কেভি বিদ্যুৎ সংযোগ চেয়ে বিদ্যুৎ বিভাগ বরাবর আবেদন করে। পরে বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে পিডিবির মতামত গ্রহণ করা হয়। পিডিবি কোম্পানিগুলোর আবেদনে সাড়া দিয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে প্রস্তুতও ছিল। তবে বিদ্যুৎ বিতরণ বিধিতে যেহেতু বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোর একজনের বিতরণ এলাকায় আরেকজনের বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া আইনসম্মত নয়, ফলে বিষয়টি নিয়ে সংকট তৈরি হয়। পরে বিষয়টি নিয়ে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের সভাপতিত্বে একটি বৈঠক অনুুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে এক বিতরণ কোম্পানির এলাকায় আরেক বিতরণ কোম্পানির বিদ্যুৎ সংযোগ সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনে কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়। কমিটি সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে।
কমিটি বলছে- নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের নামে আইনবহির্ভূতভাবে এক সংস্থার ভৌগোলিক এলাকায় অন্য সংস্থা হতে বিদ্যুৎ সংযোগ গ্রহণের জন্য গ্রাহক কর্তৃক বিদ্যুৎ সরবরাহকারী নির্বাচনের সুযোগ নেই। ফলে কোনোভাবেই ডুয়েল বা দ্বৈত লাইন বা দুটি বিতরণ কোম্পানির লাইন নির্মাণ করে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় করা উচিত হবে না। বরং প্রতিটি বিতরণ কোম্পানিকে সেই সক্ষমতা অর্জন করতে হবে, যাতে গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে পারে।
কমিটি সুপারিশ করেছে- যেহেতু সরকার শতভাগ বিদ্যুতায়নের মাধ্যমে ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে, ফলে মাঠ পর্যায়ে বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোকে ভৌগোলিক এলাকার সীমানা জটিলতা দূরীকরণে আন্তঃসংস্থা জটিলতা দূর করতে হবে। এ লক্ষ্যে বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি বা সংস্থাগুলোকে সক্ষমতা যাচাই, কর্মদক্ষতা উন্নয়ন ও আর্থিক স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে সমীক্ষা কার্যক্রম চালাতে হবে।
কমিটি তাদের সুপারিশে বলেছে- বিদ্যুৎ খাতে বিদ্যমান আইন ও নীতিমালার আলোকে এক বিতরণ কোম্পানির ভৌগোলিক এলাকায় অন্য বিতরণ কোম্পানির বিশেষ কোনো কারণ ছাড়া বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া বিদ্যুৎ আইন-২০১৮ অনুযায়ী একটি শাস্তিমূলক অপরাধ। বিদ্যমান আইনে গ্রাহককে বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান নির্বাচনের সুযোগ নেই। তবে বিদ্যুৎ আইনে আরেক ধারায় বলা হয়েছে- বর্তমানে বিদ্যমান আইনের বিধানাবলি অনুসরণ করে বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা বা কোম্পানিগুলোকে নিজ নিজ ভৌগোলিক এলাকায় বৈদ্যুতিক স্থাপনা নির্মাণ ও সম্প্রসারণ করবে এবং বিভিন্ন শ্রেণির গ্রাহকদের বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদান করবে। কোনো ব্যত্যয় করা যাবে না। যে সব এলাকায় দুটি বিতরণ কোম্পানির দ্বৈত লাইন আছে, সেগুলো সংশ্লিষ্ট ভৌগোলিক এলাকার বিতরণ কোম্পানির কাছে হস্তান্তর করতে হবে।
বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি সংস্থার অধীনে ৬৫টি শিল্প হাব এবং বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের ১০০টি অর্থনৈতিক জোনে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের লক্ষ্যে কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে। ১০০টি অর্থনৈতিক জোনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেটি বিআরইবির এলাকায়।
বিতরণ কোম্পানিগুলোর ভৌগোলিক সীমানা নিয়ে সংকট সমাধানের বিষয়ে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, আমাদের এখন সারাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। ফলে এক বিতরণ কোম্পানির এলাকায় অন্য বিতরণ কোম্পানির বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার সুযোগ নেই। যার যার বিতরণ এলাকায় সেই কোম্পানিই বিদ্যুৎ সংযোগ করবে। বার বার বলার পরও কোনো কোম্পানি এ ব্যত্যয় ঘটালে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এ বিষয়ে পিডিবির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী বেলায়েত হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, শিল্পমালিকরা পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের বিতরণ এলাকায় থেকেও পিডিবি থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ চেয়ে আবেদন করেন। কেন করেন সেটির নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। তিনি বলেন, যেহেতু মন্ত্রণালয় থেকে এক বিতরণ কোম্পানির এলাকায় আরেক বিতরণ কোম্পানির বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া বারণ আছে, সে কারণে পিডিবির কাছে কেউ বিদ্যুৎ সংযোগ চাইলেও আমরা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের জন্য পাঠিয়ে দিচ্ছি। তিনি বলেন, মন্ত্রণালয় অনুমোদন না দিলে পিডিবি বিদ্যুৎ সংযোগ দিচ্ছে না। গ্রাহকরা কেন পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের আওতায় থেকেও পিডিবির সংযোগ চান জানতে চাইলে তিনি বলেন, আরইবি মূলত পিডিবি থেকে বিদ্যুৎ কিনে গ্রাহকের কাছে বিক্রি করে। পিডিবি কম দামে আরইবির কাছে বিদ্যুৎ বিক্রি করে। আরইবি মূলত গ্রামীণ মানুষকে বিদ্যুৎ দেওয়ার কনসেপ্ট থেকে তৈরি। এখন আরইবি যদি শিল্পায়নে বিদ্যুৎ দিতে চায়, তবে পিডিবি পরবর্তীতে বিইআরসিতে আবেদন করে বিদ্যুতের মূল্য সমন্বয় করবে।
বিষয়টি নিয়ে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মঈন উদ্দিন বলেন, আমি নিজেই বিষয়টি বুঝতে পারছি না আরইবির এলাকায় শিল্পকারখানা করে কেন পিডিবির বিদ্যুৎ সংযোগ চান শিল্প গ্রাহকরা। তিনি বলেন, পল্লী বিদ্যুৎ দেশের আশি শতাংশ মানুষকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করেছে এবং যে কোনো শিল্পমালিককে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে সক্ষম। তিনি বলেন, গ্রাহকের পিডিবি না আরইবি সেটা দেখার দরকার নেই। গ্রাহকের দরকার বিদ্যুৎ। এখন কোনো গ্রাহক যদি আরইবি থেকে বিদ্যুৎ না চেয়ে পিডিবি থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ নিতে চান, সেখানে নিশ্চয়ই কারণ আছে। চেয়ারম্যান বলেন, গ্রিড লাইন নির্মাণ করে বাংলাদেশ পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)। যে কোনো শিল্পকারখানার জন্য পিজিসিবি লাইন নির্মাণ করবে আর বিতরণ কোম্পানি বিদ্যুৎ সংযোগ দেবে। শিল্পকারখানার জন্য বিদ্যুতের মূল্য একই। এখানে গ্রাহকের বিতরণ কোম্পানি পছন্দ করার বিষয়টিই সঠিক নয় বলে মনে করেন তিনি।
বিষয়টি নিয়ে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোর সীমানা নির্ধারণ বা অধিক্ষেত্র নির্ধারণ নিয়ে জটিলতা ছিল। সেটি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। আর যেখানে যেখানে এক বিতরণ কোম্পানির এলাকায় অন্য বিতরণ কোম্পানি গ্রাহকদের সংযোগ দিয়েছে, তাদেরও নির্ধারিত বিতরণ কোম্পানির কাছে তা হস্তান্তর করতে বলা হয়েছে। তবে শিল্প গ্রাহকরা এক বিতরণ কোম্পানির আওতায় থেকে অন্য বিতরণ কোম্পানির বিদ্যুৎ সংযোগ কেন চান জানতে চাইলে তিনি বলেন, আসলে দীর্ঘ সময় বিভিন্ন শিল্পকারখানা পিডিবির আওতায় ছিল। পিডিবির ১৩২ কেভি লেভেলে বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা বেশি। শিল্পমালিকদের এখনো মানসিকতার পরিবর্তন হয়নি। তারা মনে করেন পিডিবির কাছ থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ পেলে নানা ক্ষেত্রে তারা বেশি সুবিধা পাবেন; কিন্তু বিষয়টি আসলে ঠিক নয়। বিআরইবির কোথাও ১৩২ কেভি লেভেলে বিদ্যুৎ না থাকলে সেখানে সেটি করে দেওয়া হবে। তবে বিআরইবির এলাকায় শিল্পকারখানা করলে বিআরইবির এলাকা থেকেই বিদ্যুৎ নেওয়ার আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে।