ফয়েজ আহমেদ তুষার : বড় ভাটেরচর, ফুলদী, দুলালপুর, সনমান্দী। গ্রামগুলো নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জে। গ্রামগুলোর ঘরে ঘরে গ্যাসের চুলা জ্বলে। তবে এই সংযোগগুলো অবৈধ।
মেঘনা সেতু সংলগ্ন বাসস্ট্যান্ড জামালদী থেকে টেঙ্গারচর সড়কের বেইলি ব্র্রিজের উপর দিয়ে গেছে তিতাস গ্যাসের অবৈধ লাইন। লাইনটি বড় ভাটেরচর, টেঙ্গারচর, বৈদ্যেরগাঁও, মাথাভাঙ্গা হয়ে চলে গেছে আরও কয়েকটি গ্রামে। অবৈধ গ্যাসলাইন টানা হয়েছে হোসেন্দী এলাকা থেকে নাজিরচর, ফুলদী গ্রামেও। এ লাইনটি সম্প্রতি আরও সামনের দিকে সোনারকান্দী, গোসাইচর এলাকায় নেয়ার প্রস্তুতি চলছে। একই চিত্র নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ, সোনারগাঁ, গাজীপুর, নরসিংদীসহ ঢাকার আশপাশের আরও কয়েকটি জেলায়।
অবশ্য তিতাস কর্তৃপক্ষের দাবি, রাজধানীসহ আশপাশের জেলাগুলোতে নিয়মিত অভিযান চালিয়ে প্রতিষ্ঠানটি শত শত মিটার অবৈধ পাইপলাইন উচ্ছেদ করেছে। এ অভিযান চলমান আছে বলেও জানিয়েছেন তারা।
তবে জামালদী বাসস্ট্যান্ডসংলগ্ন বেইলি ব্রিজের এই অবৈধ লাইনের খবর গত বছর ২৩ অক্টোবর দৈনিক সংবাদে ছবিসহ প্রধান শিরোনাম হলেও এখনও এ লাইনটি বহাল আছে।
গ্যাস সংকটের কথা বলে আবাসিক খাতে নতুন সংযোগ দেয়া বন্ধ। তবে রাজধানীসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় অবৈধ গ্যাস সংযোগ বছরের পর বছর ধরে চলছে। অবৈধ এসব বিতরণ লাইন টানা হয়েছে কোথাও ব্রিজের উপর দিয়ে, কোথাও সড়কের পাশ দিয়ে।
সরকার নতুন গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে দেয়ার পর রাজধানীতে যেসব বাড়ির উপর দিকে বর্ধিত হয়েছে সেগুলোর বেশিরভাগ ফ্ল্যাটে, আবার নতুন নির্মিত বহুতল অনেক ভবনের বিভিন্ন ফ্ল্যাটে চলছে অবৈধ গ্যাস সংযোগ। রাজধানীর খিলগাঁও, বাড্ডাসহ কয়েকটি এলাকায় এ ধরনের অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। তবে এখনও অসংখ্য বাড়িতে অবৈধ সংযোগ রয়ে গেছে। রাষ্ট্রীয় ছয়টি গ্যাস বিতরণ কোম্পানির মধ্যে অবৈধ সংযোগ তিতাস গ্যাস কোম্পানির আওতাভুক্ত এলাকায়ই বেশি।
এসব সংযোগ দেয়ার সময় টাকা নেয়া হয়। প্রতি মাসে সংযোগ বা চুলাপ্রতি টাকাও নেয়া হয়। কিন্তু এর কোন অংশই জমা হয় না সরকারি কোষাগারে।
গজারিয়ায় অবৈধ লাইন গেছে আনারপুরা, মীরেরগাঁও, উত্তর শাহপুরের দিকে। বাউশিয়া ইউনিয়নের অনেকগুলো গ্রামেই চলছে অবৈধ সংযোগ। সোনারকান্দী, গোসাইচর গ্রামে অন্তত তিনশ’ পরিবার অবৈধ গ্যাস সংযোগের অপেক্ষায় আছে। একটি পরিবারে দ্বিমুখী একটি চুলার জন্য নেয়া হচ্ছে ১৮ হাজার টাকা। এক সময় এসব লাইন সরকার বৈধ করে দেবে বলেও আশ্বাস দিচ্ছে একটি চক্র।
নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্র বলছে, অনেক এলাকায় তিতাসের কর্মচারী ও স্থানীয়দের সমন্বয়ে গঠিত সিন্ডিকেট দ্বিমুখী চুলাপ্রতি মাসে ৭০০-৮০০ টাকা করে নিয়ে এসব সংযোগ বহাল রাখছে। বদলিজনিত কারণে এই সিন্ডিকেট ভেঙে পড়লেও কিছুদিন পর আবার তা চালু হচ্ছে।
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলায়ও আছে অবৈধ সংযোগ। পানাম নগরীর পাশে নোয়াইল, দুলালপুর এলাকায় একটি চুনের ভাটা চলছে অবৈধ গ্যাস সংযোগ নিয়ে। স্থানীয় এক ব্যক্তি সংবাদকে জানান, প্রশাসনের কাছে অভিযোগ জানিয়েও তিনি এ লাইন কাটাতে পারেননি। অভিযোগ আছে, সংশ্লিষ্টরা মোটা অঙ্কের মাসোহারার বিনিময়ে এ লাইনটি চালু রেখেছে।
আমিনপুর পৌরসভা থেকে আশপাশের এলাকাগুলোতে, পানামের রাইসদিয়া থেকে বাংলাবাজার, প্রেমেরবাজার, সনমান্দী, বড়ই কান্দিসহ আরও কযেকটি গ্রামে গেছে অবৈধ গ্যাসের লাইন। এসব গ্রামের বেশিরভাগ বাড়িতে রয়েছে অবৈধ সংযোগ। সোনারগাঁয়ের কোন কোন অবৈধ লাইন অভিযানের মাধ্যমে কাটা হয়েছে। কাটা যাওয়া হামছাদী, দামোদরদী, ছনপাড়া, টেকপাড়া, খামারগাওয়ের লাইনটি পুনরায় চালু করার চেষ্টা চলছে। স্থানীয় প্রভাবশালীদের একটি চক্র পুনঃসংযোগ দিতে চুলাপ্রতি তিন থেকে চার হাজার টাকা করে উঠিয়েছে। রূপগঞ্জ ও বন্দরেও চলছে অবৈধ গ্যাস সংযোগ।
তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী আলী ইকবাল মো. নূরুল্লাহ সংবাদকে বলেন, কেন্দ্রীয় এবং জোনভিত্তিক টিমের মাধ্যমে তিতাস গ্যাসের আওতাভুক্ত এলাকাগুলোতে অবৈধ সংযোগ উচ্ছেদে অভিযান চলছে। ‘আমাদের এলাকায় কোথাও কোন অবৈধ সংযোগ থাকবে না।’
এখনও অনেক এলাকায় অবৈধ গ্যাস সংযোগ রয়েছে- এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণের জবাবে তিতাসের এমডি বলেন, ‘তথ্যের অভাবে অনেক এলাকায় অবৈধ সংযোগ রয়ে গেছে। আমারা তথ্য সংগ্রহ করছি। দ্রুততম সময়ে সেসব অবৈধ সংযোগ উচ্ছেদ করা হবে।’
দেশে বৈধ গ্যাস সংযোগের সংখ্যা প্রায় ৪৩ লাখ। এরমধ্যে তিতাসের ২৮ লাখ ৬৫ হাজার গ্রাহকের মধ্যে আবাসিক গ্রাহক ২৮ লাখ ৪৬ হাজার। রাষ্ট্রীয় অন্য ৫টি গ্যাস বিতরণ প্রতিষ্ঠান কর্ণফুলী, পশ্চিমাঞ্চল, জালালাবাদ, বাখরাবাদ ও সুন্দরবনের মোট সংযোগ প্রায় ১৫ লাখ। গ্যাস সংকটের কারণে ২০০৯ সালে শিল্প ও বাণিজ্যিক খাতে এবং ২০১০ সালে আবাসিকে (বাসায় রান্নায়) নতুন সংযোগ বন্ধ করে দেয় সরকার। দশম সংসদ নির্বাচনের কিছুদিন আগে ২০১৩ সালের মে মাসে আবাসিক খাতে নতুন সংযোগ দেয়া চালু হয়। ওই সময় সিটি নির্বাচন সামনে রেখে রাজশাহীতেও বেশকিছু আবাসিক সংযোগ দেয়া হয়। তবে ভোটের পর তা বন্ধ হয়ে যায়।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৮ সালের এপ্রিলে আবাসিকে প্রিপেইড মিটারের মাধ্যমে গ্যাস সংযোগ চালু করার ইঙ্গিত দেয়া হয়। তবে এখন সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে আবাসিক খাতে নতুন গ্যাস সংযোগ না দেয়ার পক্ষে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে নির্ভরযোগ্য একটি সূত্রে জানা গেছে।