ফয়েজ আহমেদ তুষার: আবাসিক খাতে নতুন গ্যাস সংযোগ বন্ধ দীর্ঘদিন। ফলে শহরাঞ্চলের লাখ লাখ বাসা-বাড়িতে রান্নায় ভরসা এলপি গ্যাস। সেই এলপি গ্যাসের এক সিলিন্ডারের সরকারি মূল্য ৬০০ টাকা। বেসরকারিতে এই দাম ৯৫০ থেকে ১,২০০ টাকা। সরকারি প্রতিষ্ঠান এলপি গ্যাস লিমিটিড চাহিদা মেটাতে পারে মাত্র দুই শতাংশ। বাকিরা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর উচ্চমূল্যের শিকার।
এলপি গ্যাস আমদানির জন্য দেশে ছোট টার্মিনাল রয়েছে ২০টি। এলপি গ্যাসের ডিলার রয়েছে প্রায় তিন হাজার। খুচরা বিক্রেতার সংখ্যা ৩৮ হাজারের ওপর। জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ এবং ও ব্যবসায়ীদের হিসাবে, দেশে এলপিজি ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৩৮ লাখ। এলপিজির ৮৪% ব্যবহৃত হয় রান্নার কাজে। বাকি ১৬% এর একটা বড় অংশ যায় কলকারখানায়। গাড়িতেও এলপিজির দিন দিন ব্যবহার বাড়ছে। মোট এলপি গ্যাসের ৩৭% ঢাকায়, ১৮% চট্টগ্রামে, ১২% খুলনায়, ৮% রংপুরে, ৬% ময়মনসিংহে, ৪% বরিশালে এবং ৩% সিলেটে ব্যবহৃত হয়। এ খাতে বিনিয়োগ প্রায় দেড় বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
সিংহভাগ ভোক্তা সরকারি মূল্যে এলপি গ্যাস পায় না- বিষয়টি স্বীকার করে রাষ্ট্রীয় এলপি গ্যাস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. ফজলুর রহমান খান সংবাদকে বলেন, ‘আমরা শুধু উৎপাদন ও বোতলজাত করি। ডিস্ট্রিবিউশন করে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা। ডিলার আছে প্রায় দুই হাজার সাতশ’। এখানে ডিলাররা বেশি দাম রাখলেও নজরদারির বিষয়টি আমাদের নয়।’ তিনি বলেন, ‘প্রতিষ্ঠান থেকে স্থানীয় কিছু ভোক্তাকে সরকার নির্ধারিত মূল্যে এলপি গ্যাস দেয়ার উদ্যোগ নিয়েও স্থানীয় ডিলার ও মাফিয়াদের চাপে তা অব্যহত রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে।’
দেশে ২৭টি প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স পেলেও বর্তমানে ১৮টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এলপি গ্যাস সরবরাহ করছে। বেসরকারিভাবে বসুন্ধরা, বেক্সিমকো, যমুনা, ক্লিনহিট, টোটাল, ওরিয়ন, ওমেরা, পেট্রোম্যাক্স, লাফার্স, জি-গ্যাস, ডেলটা, প্রমিটা, জেএমআই, টিএমএসএস, নাভানাসহ ১৮টি কোম্পানি এলপিজি বাজারজাত করছে। জ্বালানি খাতের একাধিক সূত্রমতে, দেশে বর্তমানে বার্ষিক প্রায় ১৫ লাখ মেট্রিক টন এলপিজির চাহিদা রয়েছে। তবে আমদানি ও বিক্রি হচ্ছে বার্ষিক প্রায় ১০ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে ২০ হাজার মেট্রিক টন এলপিজি সরকারিভাবে বিক্রি হয়।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) বিভিন্ন সময় এলপিজির দাম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলেও সংশ্লিষ্টদের অসহযোগিতার কারণে তা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। সম্প্রতি বিইআরসি এলপি গ্যাস (লিকুইফাইড পেট্রোলিয়াম গ্যাস বা এলপিজি) এর মূল্যহার পুনঃনির্ধারণের জন্য আগামী ১৪, ১৭ এবং ১৮ জানুয়ারি গণশুনানি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ লক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারি এলপিজি কোম্পানিগুলোর কাছে মূল্য প্রস্তাব চেয়েছিল কমিশন। শুরু থেকে এ উদ্যোগে সহযোগিতা না করলেও শেষ পর্যন্ত বিইআরসিতে প্রস্তাব জমা দিয়েছে কোম্পানিগুলো।
বিইআরসির সদস্য (গ্যাস) মো. মকবুল-ই-ইলাহী চৌধুরী এ বিষয়ে সংবাদকে বলেন, ‘আমরা অনেকের প্রস্তাবনা পেয়েছি। সেগুলো যাচাই-বাছাই করতে কাজ করবে কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি। নির্ধারিত সময়েই গণশুনানি অনুষ্ঠিত হবে।’
এলপিজি সিলিন্ডারের গায়ে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য (এমআরপি) লেখার পাশাপাশি উৎপাদন ও মেয়াদোর্ত্তীণের তারিখ, খালি সিলিন্ডারের ওজন এবং গ্যাস ভরা সিলিন্ডারের ওজন কত, এসব তথ্য লেখার নির্দেশনা দিয়েছিল জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ, যা এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। সিলিন্ডারের গায়ে মূল্য লেখা না থাকায়, গ্রাহকরা প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। এলাকাভেদে খুচরা ব্যবসায়ীরা গ্রাহকদের কাছ থেকে যেমন খুশি দাম নিচ্ছেন।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আনিছুর রহমান সংবাদকে সম্প্রতি বলেন, ‘জ্বালানির মূল্য নির্ধারণের বিষয়টি দেখে বিইআরসি। এলপিজি’র মূল্য নির্ধারণের বিষয়ে আমরা অনেক আগেই তাদের চিঠি দিয়েছি। আমরা চাচ্ছি দ্রুততম সময়ের মধ্যে এলপি গ্যাসের সিলিন্ডারের গায়ে যাতে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য লেখা হয়। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এলপিজি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কথা হয়েছে। বেসরকারি এলপিজি প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবি, তারা একেক সময় একেক দামে কাঁচামাল আনে তাই অভিন্ন দাম নির্ধারণ করা কঠিন। তবে আমরা বলেছি, মূল্য নির্ধারণে সর্বশেষ কাঁচামাল আমদানির হিসাব ধরেই করা হবে। তবে সর্বোচ্চ খুচরা মূল নির্ধারণ করে সিলিন্ডারের গায়ে উল্লেখ করতেই হবে।’
বিইআরসি সূত্রে জানা গেছে, এলপিজি আমদানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশে টন প্রতি পরিবহন ব্যয় ভারতের দ্বিগুণ। এই ব্যয় কমানো গেলে দেশে এলপিজির দাম কমানো সম্ভব। জানা গেছে, ভারতের কলকাতায় এলপিজির দর কেজিপ্রতি ৫০ টাকা। বাংলাদেশে এই দাম স্থান ভেদে ৮৩ টাকা পর্যন্ত উঠছে। ভারতে এলপিজির বিপণন ব্যয় কেজিতে ১৫ টাকা হলেও বাংলাদেশে তা ৩০ থেকে ৩২ টাকা। ভারতের হলদিয়া বন্দরে টনপ্রতি এলপিজি আমদানি ব্যয় ৬০ ডলার, বাংলাদেশে এই ব্যয় ১৩০ ডলার পর্যন্ত হয়ে থাকে। সূত্রমতে, মোংলা বন্দরের হারবারিয়া এলাকায় ৩০ হাজার টন এলপিজির জাহাজ আনা সম্ভব। এটি শুরু হলে দেশে এলপিজির পরিবহন ব্যয় টনপ্রতি ৮০ ডলারে নামিয়ে আনা যাবে।
বিপিসি’র সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা এ বিষয়ে সংবাদকে জানান, কক্সবাজারের মহেশখালী-মাতারবাড়ী এলাকায় গভীর সমুদ্রে একটি বৃহৎ এলপিজি টার্মিনাল নির্মাণ করা হচ্ছে। এটি হবে রেফ্রিজারেটেড মাদার টার্মিনাল। এ থেকে বিভিন্ন এলপিজি কোম্পানির কাছে বাল্ক আকারে এলপি গ্যাস বিক্রি করা হবে। বার্ষিক ১০ থেকে ১২ লাখ মেট্রিক টন ক্ষমতার এই টার্মিনালের জেটিতে প্রায় ৪০ হাজার মেট্রিক টন ধারণ ক্ষমতার রেফ্রিজারেটেড এলপি গ্যাসবাহী জাহাজ এখানে নোঙর করতে পারবে। টার্মিনালে ক্ষমতা হবে ৫০ হাজার মেট্রিক টন। টার্মিনাল হতে দেড় থেকে চার হাজার মেট্রিক টন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন জাহাজে বাল্ক এলপি গ্যাস দেশি কোম্পানিগুলোকে সরবরাহ করা হবে। এটি বাস্তবায়ন হলে দেশে এলপিজির দাম কমে আসবে বলে তার আশা।