প্রথমবারে মতো এলপি গ্যাসের (তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাস) খুচরা মূল্য নির্ধারণের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। বহুমুখী বাজার, অর্ধশতাধিক কোম্পানি, হাজার হাজার পরিবেশক, লক্ষাধিক খুচরা বিক্রেতা, সর্বোপরি অস্থিতিশীল বাজার বিষয়টিকে বেশ জটিল করে তুলেছে।
রেগুলেটরি অথরিটি বিইআরসি সাধারণ বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য নির্ধারণ করে অভ্যস্থ হয়ে ওঠেছে। বিদ্যুৎ-গ্যাসের সুবিধা ছিল পণ্য দুটির পাইকারি বিক্রেতা একমাত্র সরকার। আবার বিদ্যুতের খুচরা বিক্রেতাও সরকারি ৬টি কোম্পানি। যে কারণে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য একটি ফরমেটে চূড়ান্ত করার সুযোগ থাকলেও এলপি গ্যাসের বিষয়টি পুরোপুরি ভিন্ন।
দেশে ব্যবহৃত এলপিজির সাড়ে ৯৮ ভাগ আমদানি নির্ভর। সেখানে সরকারি কোম্পানির মার্কেট শেয়ার মাত্র দেড় শতাংশ। সরকার এখন পর্যন্ত ৫৬টি কোম্পানি অনুমোদন দিয়েছে। এরমধ্যে ২৮টি মার্কেটে রয়েছে ২০টি প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমদানি পর্যায়ে আবার একেকটি কোম্পানি একেক মার্কেট থেকে আমদানি করছে। কেউ আনছেন দীর্ঘ মেয়াদী চুক্তির আওতায়, কেউ কেউ স্পট মার্কেট (খোলা বাজার) থেকে। এতে করে আমদানি পর্যায়ে দরের হেরফের হচ্ছে। আবার কোন ধরনের শিপে (ছোট/বড়) আনা হচ্ছে সেখানেও দরের তারতম্য বিদ্যমান। এতে বিষয়টি বেশ জটিল হয়ে দেখা দিয়েছে। যদিও কোম্পানিগুলো অনেকে সৌদি রেটের উপর ভিত্তি করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে উঠানামা করবে এভাবে দর নির্ধারণের পক্ষে।
প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক ই ইলাহী চৌধুরী এক সেমিনারে বলেছেন, খুব ঘন ঘন দর উঠা-নামা করলে ভোক্তাদের মধ্যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হতে পারে। সে কারণে যতটা সম্ভব কম কমা-বাড়া করা গেলে ভালো। পাশাপাশি ক্রস সাবসিডি দেওয়ার বিষয়ে ইতিবাচক অভিমত দেন।
ক্রস সাবসিডির বিষয়টি বিইআরসির এক রিপোর্টে সামনে এসেছে। অনেক দিন ধরেই একটি বিষয় আলোচিত ছিল কেউ পাইপ লাইনে কমদামে গ্যাস পাবে। অন্যরা বেশি দামে এলপিজি কিংবা লাকড়ি ব্যবহার করবেন এটি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাই বিষয়টিতে সমতা আনার জোর দাবি ছিল। তারই প্রতিফলন মনে করা হচ্ছে বিইআরসির চিঠি। জ্বালানি বিভাগে পাঠানো একটি চিঠিতে সাশ্রয়ী মূল্যে এলপিজি সরবরাহের জন্য আমদানি পর্যায়ে ২৫ শতাংশ ভর্তুকির দেওয়া সুপারিশ করা হয়। এতে বলা হয়েছে পাইপলাইনের গ্যাসের গ্রাহকদের উপর চার্জ বসিয়ে ভর্তুকির অর্থ সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব।
সুপারিশে বলা হয়েছে এলপিজির বাজার স্থিতিশীল নয়। সে কারণে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকাসহ এশীয় অঞ্চলের দেশ সমূহ সৌদি আরামকো নির্ধারিত প্রতিমাসের দর স্ব-স্ব দেশের এলপিজির দর নির্ধারণের সূচক বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশেও এমন নিয়ম ফলো করার পক্ষে, এ ক্ষেত্রে স্বয়ংক্রিয়ভাবে দর নির্ধারণের সুযোগ রাখা যেতে পারে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরাও অনেকে এই মতের সঙ্গে একমত। তারা মনে করছেন প্রত্যেকমাসে গণশুনানি তারপর দর নির্ধারণ করার বিষয়টি সমসাপেক্ষ ও জটিল। সে কারণে স্বয়ংক্রিয়ভাবে হলেই ভালো। এতে কারো বেশি লাভ কিংবা কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সুযোগ কম থাকবে।
তাদের প্রস্তাব হচ্ছে,দর নির্ধারণের ক্ষেত্রে দুটি ফ্যাক্টর বিবেচনা করা উচিত। একটি হচ্ছে এনার্জির কষ্ট অর্থাৎ আমদানিকৃত এলপিজির মূল্য। আরেকটি থাকবে পরিবহন খরচ, কোম্পানির ও পরিবেশকের মুনাফা এবং অন্যান্য। আরামকোর দরের সঙ্গে শুধু এনার্জি দর উঠানামা করবে। আর অন্যান্য কষ্ট অপরিবর্তিত থাকবে।
তবে স্বংক্রিয় দরের বিপক্ষে মত দিয়েছেন ক্যাবের জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম। তিনি বার্তা২৪.কম’কে বলেছেন, স্বংক্রিয় করার বিষয়ে আইন পারমিট করে না। আমরা তাদের বেতন দিচ্ছি তারা এটি করবে। সক্ষমতা না থাকলে প্রয়োজনে তারা সক্ষম হবে। দর পরিবর্তন হলে সেই পণ্য দেশে আসতে ৩০ থেকে ৪৫ দিন সময় প্রয়োজন হয়। তখন আবার গণশুনানি করবে।
দর নির্ধারণ প্রক্রিয়া প্রসঙ্গে বলেন, কোম্পানিগুলো স্বচ্ছভাবে বলবেন তাদের কতো কেনা পড়েছে। তার উপর ভিত্তি করে দর চূড়ান্ত হবে। মনগড়া কিছু তথ্য দিয়েছে, সাপোর্টিং কোনো কাগজ দিতে পারেনি। ক্রয়মূল্য ও সাপ্লাই চেইনের খরচের যৌক্তিকতা কোম্পানিগুলোকে প্রমাণ করতে হবে। মামলাতে যেমন সাক্ষীসাবুদ দিয়ে প্রমাণ করতে হয়। এলপিজি অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে দর নির্ধারণের আবেদন করেছে। তারা কোনো লাইসেন্সি না, তারা নিবন্ধিত কোনো সংগঠন নয়। তারা প্রস্তাব করতে পারে না। আমরা তাদের বিষয়ে আপত্তি দিয়েছি। তারা জেরা বা বিবৃতি পর্বে অংশ নিতে পারেন শুধু।
এতদিন পর্যন্ত এলপিজির দর ছিল কোম্পানিগুলোর ইচ্ছাধীন। দর নির্ধারণের বিষয়ে অনেকদিন ধরেই কথা হলেও জ্বালানি বিভাগ, বিইআরসি নাকি বিপিসি করবে সে নিয়ে ছিল রশি টানাটানি। সর্বশেষ ক্যাবের এক রিটের প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট এলপিজির দর নির্ধারণ করার জন্য বিইআরসিকে নির্দেশ দেয়। সে মোতাবেক দর চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে, ১৪ জানুয়ারি বিয়াম অডিটরিয়ামে গণশুনানি হবে। ওই শেষ না হলে ১৭ এবং ১৮ জানুয়ারি শুনানি করা হবে। ১২ কেজি ওজনের সিলিন্ডার প্রতি প্রমিতা এলপিজি ৮৫৩ টাকা, সরকারি কোম্পানি বিএলপিজি ৭০০ টাকা, এলপিজি অপরেটস এসোসিয়েশন ১২৫৯ টাকা করার প্রস্তাব জমা দিয়েছে।
অন্যদিকে প্রপেন ও বিউটের সংমিশ্রণ হচ্ছে এলপিজি। দরের মতো একেক কোম্পানি একেক মিশ্রণে বাজারজাত করছে। বাংলাদেশের একশ বছরের তাপমাত্রা রেকর্ড অনুযায়ী সর্বোচ্চ ৪৫ ডিগ্রি, সর্বোনিম্ন ২.৬ তাপমাত্রার রেকর্ড রয়েছে। তাপমাত্রা অনুযায়ী গৃহস্থালী ও যানবাহনে ব্যবহারের প্রপেন ৩০ হতে ৪০ শতাংশ এবং বিউটেন ৭০ থেকে ৬০ শতাংশ উপযোগী হবে বলে বিইআরসির রিপোর্টে বলা হয়েছে।
২০০৮-০৯ অর্থ বছরে দেশে এলপিজি ব্যবহৃত হয়েছে ৪৪ হাজার ৯৭৪ মেট্রিক টন। কয়েক বছরে চাহিদা বেড়ে ১২ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে। জাইকার এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ২০২৫ সালে ৩০ লাখ টন ও ২০৪১ সালে চাহিদা হবে ৬০ লাখ টন।
জ্বালানি বিভাগের যুগ্ম সচিব ড. মুহা শের আলী বার্তা২৪.কম’কে বলেছেন, গত ১০ বছরে ব্যাপক আকারে এলপিজির ব্যবহার বেড়েছে।