লুৎফর রহমান কাকন :
অনেক জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে বাংলাদেশ-ভারতের ‘বাংলাদেশ-ভারত ফ্রেন্ডশিপ তেলের পাইপলাইন’ অগ্রাধিকার প্রকল্পটির মাঠপর্যায়ের কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় চলতি বছরের প্রথম সপ্তাহে। তবে কাজ শুরু না হতেই জমি অধিগ্রহণ, ডিসি অফিসের লোকবল সংকটে প্রকল্পের কাজে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।
প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, দুদেশের ঠিকাদারদের কাজের পুরো প্রস্তুতি থাকলেও জমি অধিগ্রহণ জটিলতায় পাইপলাইন নির্মাণের কাজ পুুরোদমে করতে পারছে না। ফলে প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে কাজ না করে বসে আছে ঠিকাদারদের লোকবল।
পঞ্চগড় জেলার আওতায় ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণের অর্থ কৃষকরা না পাওয়ায় সেখানে পাইপলাইন স্থাপনের কাজ করা যাচ্ছে না। জমির দখল পাচ্ছে না প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। পঞ্চগড় জেলা প্রশাসক ড. সাবিনা ইয়াসমিন তার জেলায় ভূমি অধিগ্রহণের কাজে প্রয়োজনীয় লোকবল সংকটের কথা তুলে ধরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছেন। গত ১০ ডিসেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর দেওয়া চিঠিতে লিখেছেন, জেলার ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তার পদ দীর্ঘদিন শূন্য থাকায় রাজস্ব প্রশাসনের কাজকর্ম সঠিকভাবে সম্পন্ন করা যাচ্ছে না। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, সরকারের বিশেষ অগ্রাধিকার প্রকল্প বাস্তবায়নে ভারত-বাংলাদেশ প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণ ও হুকুম দখল কার্যক্রম চলছে। এ ছাড়া জেলার ৪ উপজেলায় ৬৭টি মৌজায় প্রায় চার হাজার জমির পাঁচ হাজার ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক জমির টাকা ও ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। তবে ভূমি অধিগ্রহণ শাখায় প্রয়োজনীয় লোকবাল না থাকায় কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।
বিষয়টি নিয়ে বিপিসির পরিচালক অপারেশন সৈয়দ মেহেদী হাসান বলেন, বিপিসি প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজনীয় অর্থ জেলা প্রশাসকদের অফিসে দিয়ে দিয়েছে বিপিসি। তবে পঞ্চগড়সহ দুয়েকটি জেলায় এখনও জমি অধিগ্রহণ বা হুকুম দখল কার্যক্রম সম্পন্ন করতে পারেনি ডিসি অফিসগুলো। ফলে ঠিকাদাররা কার্যক্রম পুরোদমে চালাতে পারছে না।
প্রসঙ্গত, চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) চেয়ারম্যান আবু বকর ছিদ্দীক পাইপলাইন স্থাপনের কাজ উদ্বোধন করেন। লক্ষ্য ছিল দিনাজপুরের সোনাপুকুর চিরিরন্দর এলাকায় প্রথম পর্যায়ে ৫০ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপনের মধ্য দিয়ে প্রকল্পের কাজ শুরু করা। বাংলাদেশের দীপন গ্যাস কোম্পানি ৫০ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপনের কাজ করবে। ভারতীয় একটি কোম্পানি বাকি ৭৫ কিলোমিটার কাজ করবে।
বিষয়টি নিয়ে প্রকল্প পরিচালক মো. টিপু সুলতান আমাদের সময়কে বলেন, নীলফামারী-দিনাজপুর এলাকায় ৩০ কিলোমিটার জমির দখল পেয়েছে; যার মধ্যে ১৫ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপনের কাজ হয়েছে। তিনি বলেন, পঞ্চগড় জেলার দিকে কিছুটা সংকট রয়েছে। ফলে পুরোদমে কাজ শুরু করা যাচ্ছে না।
বিপিসি সূত্রে জানা যায়, পাইপলাইন কাজ তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এক অংশে রয়েছে ৫০ কিলোমিটার, আরেক অংশে ৭০ এবং ভারতের অংশে ৫ কিলোমিটার। দুটি কোম্পানি পাইপলাইন স্থাপনের কাজ করবে। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের দীপন গ্রুপ এবং ভারতের ক্রোটেক।
পাইপলাইন দিয়ে ১৫ বছর তেল আমদানি করা হবে। প্রথম তিন বছর দুই লাখ মেট্রিক টন, পরবর্তী তিন বছর তিন লাখ, পরবর্তী চার বছর পাঁচ লাখ, অবশিষ্ট পাঁচ বছর ১০ লাখ মেট্রিক টন।
২০১২ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে প্রস্তাব দেওয়া হয় ভারতে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান নুমালীগড় রিফাইনারি লিমিটেড (এলআরএল) থেকে বাংলদেশে পাইপলাইনে জ্বালানি তেল সবরাহ করার। তাদের প্রস্তাব বিবেচনায় নিয়ে দুই দেশের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের একাধিক বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে পাইপলাইল স্থাপন এবং ভারত থেকে জ্বালানি তেল আমদানির সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি আইন-২০১০ এর আওতায় ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান নুমালীগড় রিফাইনারি লিমিটেডের (এলআরএল) শিলিগুড়ি মার্কেটিং টার্মিনাল থেকে বাংলাদেশের দিনাজপুর জেলার র্পাবতীপুর ডিপো পর্যন্ত ভারত-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইন (আইবিএফপিএল) নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ প্রকল্পের আওতায় শিলিগুড়ি মার্কেটিং টার্মিনাল হলে পাবর্তীপুর ডিপো পর্যন্ত ১৩০ কিলোমিটর পাইপলাইন স্থাপন করতে হবে।
বিপিসি সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশের ১২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইনের জন্য প্রায় ১৪৭ দশমিক ৩৪ একর জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। একই সঙ্গে হুকুম দখল করতে হবে ১২৬ দশমিক ১৪ একর। পাইপলাইন রুটে তিনটি জেলার মধ্যে পঞ্চগড় এলাকায় ১২১ দশমিক ৩৫ একর, দিনাজপুর জেলায় ৫২ দশমিক ০১৮ একর, নীলফামারী জেলায় ১৪ দশমিক ২৮ একর জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। পঞ্চগড়ে হুকুম দখল করতে হবে ৮২ দশমিক ১৮৯ একর, দিনাজপুরে ৩৩ দশমিক ৪৪ একর, নীলফামারীতে নয় দশমিক ৪৯ একর। এ ছাড়া পাবর্তীপুর রেলওয়ের ভূমিতে ৬টি তেলের স্টোরেজ ট্যাংকার নির্মাণ করতে হবে। এর জন্য সাড়ে পাঁচ একর জমি অধিগ্রহণ করতে হবে।
পাইপলাইন বাংলাবান্ধা থেকে পার্বতীপুর যাওয়ার পথে একাধিক নদী, সড়ক ও রেলপথ অতিক্রম করবে। বিআইডব্লিউটি-এর অধীনে চারটি নদীর (তিস্তা, ইছামতী, করতোয়া, ডাউক নদী) ৬টি পয়েন্ট এবং রেলওয়ের অধীনে ৩টি পয়েন্ট সড়ক ও জনপথের চারটি পয়েন্ট এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের অধীনে ২৮ পয়েন্ট অতিক্রম করবে। এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে ভারত সরকার গ্রান্ড ইন এইড প্রোগ্রামের আওতায় ৩০৩ কোটি রুপি অর্থায়ন করবে। বাংলাদেশ ৩০৬ কোটি টাকা ব্যয় করবে।