সাড়া দেয়নি সরকারি কোম্পানি উচ্চ আদালতে শুনানি আজ
ফয়েজ আহমেদ তুষার : এলপি গ্যাসের মূল্য পুনঃনির্ধারণে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) আহ্বানে বেসরকারি ব্যবসায়ীরা প্রস্তাব জমা দিলেও সাড়া দেয়নি সরকারি প্রতিষ্ঠান ‘এলপি গ্যাস লিমিটেড’। এর ফলে সব প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে যথাসময়ে গণশুনানি করে মূল্য পুনঃনির্ধারণে জটিলতা তৈরি হয়েছে। এদিকে গণশুনানির মাধ্যমে এলপিজির (তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস) দাম নির্ধারণ করে প্রতিবেদন দাখিল না করায় বিইআরসি’র চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার যে রুল জারি হয়েছে হাইকোর্টে আজ তার শুনানি হবে।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) আওতাধীন কোম্পানি এলপি গ্যাস লিমিটেড বলছে, ‘দ্যা পাবলিক করপোরেশন অর্ডিনেন্স, ১৯৮৬’ শীর্ষক অধ্যাদেশ অনুযায়ী বিপিসির আওতাধীন কোম্পানির পণ্যের দাম নির্ধারণের দায়িত্ব বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের। ফলে বিইআরসিতে প্রস্তাব পাঠাতে হলে করপোরেশন অর্থাৎ বিপিসির অনুমোদন লাগবে। এদিকে জাতীয় সংসদে পাস হওয়া ‘বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন আইন, ২০০৩’ অনুযায়ী, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পেট্রোলিয়াম জাতীয় পদার্থের ট্যারিফ নির্ধারণের এখতিয়ার কমিশনের (বিইআরসি’র)।
বিইআরসি’র চেয়ারম্যান মো. আবদুল জালিল গতকাল দুপুরে সংবাদকে বলেন, ‘এলপিজি’র মূল্য পুনঃনির্ধারণে আমরা সরকারি-বেসরকারি সব কোম্পানির কাছে প্রস্তাব চেয়েছিলাম। একবার সময়ও বাড়ানো হয়েছে। গতকাল শেষ দিনে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে এলপিজি অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (লোয়াব) একটি সম্মিলিত প্রস্তাব কমিশনে জমা দিয়েছে।’
সরকারি এলপি গ্যাস লিমিটেড প্রস্তাব জমা না দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বিইআরসি চেয়ারম্যান মো. আবদুল জালিল সংবাদকে বলেন, ‘আইনে আছে বিইআরসি এসব পণ্যের ট্যারিফ নির্ধারণ করবে। এলপি গ্যাস লি. চলছে নীতিমালার আওতায়। আইনের চেয়ে তো অধ্যাদেশ বড় হতে পারে না।’ চেয়ারম্যান বলেন, ‘এ বিষয়ে বিপিসিকে চিঠি দেয়া হয়েছে। আমি আশা করি বিপিসি এ বিষয়ে আমাদের কাছে আসবে। আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি সমাধান হবে।’
প্রাকৃতিক গ্যাসের সরবরাহ কমায় গত এক যুগ ধরে দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে আমদানিনির্ভর এলপিজির বাজার। কিন্তু সে অনুপাতে বাজার শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা এবং গ্রাহক নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, প্রতিবেশী ভারতের পশ্চিম বাংলার তুলনায় বাংলাদেশে এলপিজির দর কেজি প্রতি অন্তত ৩০ টাকা বেশি। দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের আর কোন নতুন সংযোগ দেয়া হচ্ছে না। আবার এলপিজির দামও নির্ধারণ করা হচ্ছে না। এতে এলপিজি ব্যবসায়ীরা নিজেদের ইচ্ছামাফিক দরে এলপিজি বিক্রি করছে। এ নিয়ে ভোক্তারা অনেক বছর ধরে অভিযোগ করে আসছেন।
এ বিষয়ে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-এর (ক্যাব) এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। সে অনুযায়ী গণশুনানির মাধ্যমে এলপিজির দাম নির্ধারণ করে গত ২৯ নভেম্বরের প্রতিবেদন দাখিল না করায় কমিশনের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল জারি হয়। দুই সপ্তাহের মধ্যে এ রুলের জবাব দিতে বলা হয়। একইসঙ্গে আগামী ১৫ ডিসেম্বর এ মামলার পরবর্তী শুনানির দিন নির্ধারণ করা হয়।
এ বিষয়ে বিইআরসি’র চেয়ারম্যান সংবাদকে বলেন, ‘আগামীকাল (মঙ্গলবার) (আজ) হাইকোর্টে আমাদের ‘হিয়ারিং’ আছে। এরপর সরকারি এলপি গ্যাস লি.-এর বিষয়ে এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রস্তাব নিয়ে কমিশনে বিস্তারিত আলোচনা হবে। আগামী ১৪, ১৭ ও ১৮ জানুয়ারি গণশুনানির যে কর্মসূচি রয়েছে আশা করি তা যথাসময়ে সম্পন্ন হবে।’
জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, দেশে প্রতি মাসে প্রায় ১ লাখ মেট্রিক টন এলপিজি ব্যবহৃত হচ্ছে। এরমধ্যে ৮৪ শতাংশ ব্যবহৃত হয় রান্নার কাজে। বাকি ১৬ শতাংশ পরিবহনের অটোগ্যাস, শিল্প ও বাণিজ্য খাতে ব্যবহার করা হয়। দেশে লাইসেন্সপ্রাপ্ত ২৮টি বেসরকারি কোম্পানির মধ্যে ২০টি এলপিজি আমদানি করছে। এগুলোর বাইরে এলপি গ্যাস লিমিটেড একমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে এলপিজি বিপণন করছে।
দেশে চাহিদার ৯৮ শতাংশ এলপিজি বেসরকারি উদ্যোগে এবং দুই শতাংশ সরকারি উদ্যোগে যোগান দেয়া হয়। সরকারি প্রতিষ্ঠান খুচরা পর্যায়ে সড়ে বারো কেজির প্রতিটি সিলিন্ডার বর্তমান ৬শ’ টাকায় বিক্রি করছে। তবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো একই সিলিন্ডারের দাম এলাকাভেদে ৯শ’ থেকে এগারোশ’ টাকা পর্যন্ত রাখছে। করোনা সংক্রমণ শুরুর পর বিশ্ববাজারে এলপিজির দাম অনেকটা কমে গেলেও তার প্রতিফল ঘটেনি দেশের বাজারে। এমন প্রেক্ষাপটে বাজারে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় ও গ্রাহক স্বার্থ রক্ষায় এলপিজি গ্রাহকদের ভর্তুকি দেয়ার সুপারিশও করেছে বিইআরসি।
গত অর্থবছরে প্রায় সাড়ে আট লাখ টন এলপিজির চাহিদা ছিল। সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বলছে, ২০৪১ সালের মধ্যে চাহিদার পরিমাণ দাঁড়াবে ৮০ লাখ মেট্রিক টন। দেশের উদ্যোক্তারা এলপিজি আমদানি করে দেশের চাহিদা মেটানোর সঙ্গে সঙ্গে ভারতের ত্রিপুরা এবং আফ্রিকার কিছু অঞ্চলে এলপিজি আবার রপ্তানিও করছে। কিন্তু দেশেই এখন এলপিজির দাম নিয়ে মানুষের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। আদালতের নির্দেশে এবার সেই দাম সমন্বয় করতে যাচ্ছে কমিশন। এলপিজির মূল্য পুনঃনির্ধারণের আগামী ১৪, ১৭ ও ১৮ জানুয়ারি গণশুনানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিইআরসি।