দেশের জ্বালানি মিশ্রণে কয়লার পরিমাণ কমানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। বাতিল করা হবে বেশ কিছু কয়লাভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প। এর পরিবর্তে তরলিকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) ব্যবহার বাড়ানো হবে। সে অনুযায়ী পাওয়ার সিস্টেম মাস্টারপ্ল্যান বা বিদ্যুত্ মহাপরিকল্পনাও হালনাগাদ করা হবে। কয়লা পরিবহন ও সংরক্ষণে জটিলতা, প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি এবং আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় এই নতুন পথ গ্রহণ করছে সরকার। পাশাপাশি বিশ্ববাজারে এলএনজির দামে শিগিগরই বড় পরিবর্তন না আসার পূর্বাভাস এবং পরিবেশগত ক্ষতি কমানোর অংশ হিসেবে এই পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
বিদ্যুত্, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যে এ পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে। এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরামর্শ ও সিদ্ধান্তের অপেক্ষা। শিগিগরই বিদ্যুত্ ও জ্বালানি খাতের সার্বিক চিত্র ও পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি পাঠাবে বিদ্যুত্ বিভাগ। মন্ত্রণালয়ের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ‘ইতিমধ্যে যে কয়লাবিদ্যুত্ প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে এবং বর্তমানে যেগুলো বাস্তবায়নাধীন আছে, শুধু সেই প্রকল্পগুলোই সম্পন্ন করতে চাই। এর বাইরে অনুমোদন পাওয়া বা বাস্তবায়নের অপেক্ষায় থাকা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতের সব প্রকল্পই বাতিল করার চিন্তা রয়েছে।’ বিদ্যুত্ বিভাগ সূত্র জানায়, সরকার মোট ২৩টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছে। এখন পর্যন্ত নির্মিত হয়েছে তিনটি। নির্মাণাধীন রয়েছে সাতটি। কাজ শুরু হয়নি ১৩টির। বিদ্যুত্ বিভাগের প্রস্তাবনায় প্রধানমন্ত্রী সম্মতি দিলে এই ১৩টি প্রকল্প বাতিল হয়ে যাবে।
বাংলাদেশ বিদ্যুত্ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সূত্র জানায়, দেশের বিদ্যুেকন্দ্রগুলোর সম্মিলিত উত্পাদনক্ষমতা দৈনিক ২০ হাজার ৩৮৩ মেগাওয়াট। এর বিপরীতে দৈনিক বিদ্যুত্ ব্যবহূত হয় ১০ হাজার মেগাওয়াটেরও কম। চাহিদা থাকা সত্ত্বেও সঞ্চালন ও বিতরণ লাইনে অক্ষমতা-ত্রুটির কারণে সক্ষমতার অনেকখানি ব্যবহার করা যাচ্ছে না।
বিদ্যুত্, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, সরকার যতটুকু সম্ভব কম খরচে বিদ্যুত্ উত্পাদন করতে চায়। কেননা, উত্পাদন খরচ কমলে খুচরা মূল্যও কমানো যাবে। কয়লা ও এলএনজি—দুটিই আমদানিনির্ভর। তাই সর্বোচ্চ সমন্বয়ের চেষ্টা হবে। আর কয়লাভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণের প্রকল্প নিয়ে কয়েক দফা সময় বাড়িয়েও উত্পাদন বা নির্মাণকাজ শুরু করতে পারেনি অনেকে। চুক্তির নিয়ম অনুযায়ী এগুলোর বিষয়েও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।
তবে বিশেষজ্ঞ ও নাগরিক প্রতিনিধিরা দীর্ঘদিন ধরে বলছেন, আমদানিনির্ভর কয়লা ও এলএনজিতে ভর না করে দেশে গ্যাস-খনিজ অনুসন্ধানে জোর দেওয়া উচিত। সেটি বেশি টেকসই ও সাশ্রয়ী হবে। তবে দেশের সমুদ্রভাগে অনুসন্ধান কার্যক্রম এখনো শূন্যের ঘরে। স্থলভাগেও সম্ভাবনাময় এলাকায় এখনো অনুসন্ধান বাকি রয়েছে।
বিদ্যুত্ বিভাগের নীতি-পরামর্শ ও বিশ্লেষণী সংস্থা পাওয়ার সেলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৯ সালের পর সরকারি-বেসরকারি যেসব কয়লাভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্রের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল, চুক্তি অনুযায়ী সেসব সময়মতো উত্পাদনে আসতে পারেনি। যেসব প্রকল্পে তিন থেকে সাত বছরের মধ্যেও কোনো অগ্রগতি নেই, সেসব বিদ্যুেকন্দ্রের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করা দরকার।
কয়লাবিদ্যুতের বাস্তবায়িত তিনটি প্রকল্প হলো—পটুয়াখালীর পায়রায় ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুেকন্দ্র এবং বড়পুকুরিয়ার দুটি কেন্দ্র। বড়পুকুরিয়ার দুটি কেন্দ্রের উত্পাদনক্ষমতা ৫২৫ মেগাওয়াট। সরকারি, বেসরকারি ও যৌথ বিনিয়োগের নির্মাণাধীন প্রকল্পগুলো হলো—সিপিজিসিবিএলের কক্সবাজারে মাতারবাড়ী ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল তাপবিদ্যুেকন্দ্র, এসএস পাওয়ারের চট্টগ্রামে ১ হাজার ২২৪ মেগাওয়াট, বরিশাল ইলেকট্রিক পাওয়ার কোম্পানির ৩০৭ মেগাওয়াট কেন্দ্র, বিআইএফপিসিএলের রামপালে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট কেন্দ্র, বিসিপিসিএলের পায়রায় দ্বিতীয় ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট কেন্দ্র এবং আরপিসিএল ও নরিনকো ইন্টারন্যাশনালের পুটয়াখালীতে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুেকন্দ্র। এই প্রকল্পগুলোর কয়েকটির কাজ প্রায় ৫০ ভাগ এগিয়েছে।
এদিকে কয়েক দফা সময় নিয়েও নির্ধারিত সময়ে কাজ শুরু করতে না পারা কেন্দ্রের সংখ্যা ১৩। এগুলোর মধ্যে রয়েছে—মাতারবাড়ীতে দ্বিতীয় পর্যায়ে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুেকন্দ্র, এপিএসসিএলের পটুয়াখালী ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট কেন্দ্র ও উত্তরবঙ্গ ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট কেন্দ্র, ওরিয়নের মাওয়া ৫২২ মেগাওয়াট কেন্দ্র, গজারিয়া ৬৩৫ মেগাওয়াট কেন্দ্র, ঢাকা ২৮২ মেগাওয়াট কেন্দ্র, চট্টগ্রাম ২৮২ মেগাওয়াট কেন্দ্র ও খুলনা ৫৬৫ মেগাওয়াট বিদ্যুেকন্দ্র। কাজ শুরু হয়নি চট্টগ্রামে হংকংভিত্তিক কনসোর্টিয়ামের মিরসরাই ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুেকন্দ্রের, মহেশখালীতে বে অব বেঙ্গল পাওয়ার কোম্পানির ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের, সিপিজিসিবিএল-সুমিতমো করপোরেশনের ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াটের, মহেশখালীতে পিডিবির ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের এবং সিপিজিসিবিএলের বাংলাদেশ-সিঙ্গাপুর ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুেকন্দ্রের।
এদিকে পাওয়ার সেলের প্রতিবেদনে দেখানো হয়, অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র নির্মিত হলে পরিবেশগত ক্ষতি অপেক্ষাকৃত কম হয়। তবে ক্ষতি এড়ানো যায় না।