Forum for Energy Reporters Bangladesh
Image default
Bangla News

বিদ্যুতে পাঁচ মাসেই ভর্তুকি ৩ হাজার ৯২১ কোটি টাকা

ভাড়াভিত্তিক বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কেনায় প্রতি বছরই লোকসানের অংক বড় হচ্ছে এ খাতের সবচেয়ে বড় সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি)। এজন্য বিপুল অর্থ ভর্তুকিও দিতে হচ্ছে সরকারের। মে থেকে সেপ্টেম্বর—পাঁচ মাসে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৯২১ কোটি ২ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেটে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৯ হাজার কোটি টাকা। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

সম্প্রতি মে, জুন ও জুলাইয়ের জন্য ভর্তুকি বাবদ টাকা ছাড় করেছে অর্থ বিভাগ। অর্থ ছাড়পত্রে বলা হয়, ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্লান্ট (আইপিপি), রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্রের মে, জুন ও জুলাইয়ের বিল পরিশোধের জন্য ২ হাজার ৩৬৩ কোটি ২ লাখ টাকা চলতি অর্থবছরের বিদ্যুৎ ভর্তুকি খাতে বরাদ্দকৃত অর্থ হতে বিপিডিবির অনুকূলে ছাড়া করা হয়েছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, এছাড়া আগস্ট ও সেপ্টেম্বরের জন্য আরো ১ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা ছাড়ের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। সব মিলিয়ে মাত্র পাঁচ মাসেই এ খাতে ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে ৩ হাজার ৯২১ কোটি ২ লাখ টাকা।

মঞ্জুরি আদেশে বেশ কয়েকটি শর্ত জুড়ে দেয়া হয়। শর্তগুলো হচ্ছে এক্ষেত্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ কমাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। এ অর্থ রেন্টাল, কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্লান্ট ও আইপিপির বিল পরিশোধ ব্যতীত অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যাবে না। বিল পরিশোধের বিবরণী পরবর্তী প্রস্তাবের সাথে পাঠাতে হবে। এছাড়া আইপিপি, রেন্টাল পারওয়ার প্লান্ট ও কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্লান্টের মাসভিত্তিক আর্থিক ক্ষতির বিবরণী পৃথকভাবে পরবর্তী মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে অর্থ বিভাগে পাঠাতে হবে। এ অর্থ ভবিষ্যতে অডিটের মাধ্যমে নিরূপিত মোট প্রদেয়া অর্থের সাথে সমন্বয় করতে হবে।

অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, বাজেটে সবকিছু দিন বিবেচনা করে বরাদ্দ রাখতে হয়। কিন্তু বিদ্যুৎ খাতের জন্য ভর্তুকি বাবদ যে বরাদ্দ রাখা হয় তা দিয়ে তাদের চাহিদা মেটে না। তাই পরবর্তী বাজেটের অর্থ দিয়ে আগের বাজেটের চাহিদা মেটাতে হয়।

গত বাজেটে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ৯ হাজার টাকা। কিন্তু আট মাসেই সে টাকা শেষ হয়ে যায়। তাই অর্থবছরের বাকি চার মাসের (মার্চ, এপ্রিল, মে ও জুন) ভর্তুকি চলতি বাজেটের বরাদ্দ থেকে দেয়া হচ্ছে। মে, জুন ও জুলাইয়ের বিল পরিশোধের জন্য সম্প্রতি ২ হাজার ৩৬৩ কোটি ২ লাখ টাকা চলতি অর্থবছরের বাজেটে বরাদ্দ থেকে দেয়া হয়েছে। এছাড়া আইপিপি, রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্রের আগস্ট ও সেপ্টেম্বরের বিল পরিশোধে ভর্তুকি বাবদ আরো ১ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা চেয়ে চিঠি দেয় বিদ্যুৎ বিভাগ। যাচাই-বাছাই শেষে এ অর্থ ছাড় করবে অর্থ বিভাগ।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়িয়েছে ২৩ হাজার ৫৪৮ মেগাওয়াট। তবে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ উৎপাদন ১৩ হাজার মেগাওয়াটের কম। অর্থাৎ উৎপাদন সক্ষমতার অর্ধেক বিদ্যুৎও উৎপাদন হচ্ছে না। ফলে অলস বসিয়ে রাখতে হচ্ছে অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্রই।

বেসরকারি কেন্দ্রের বিদ্যুৎ ব্যবহার না করলেও চুক্তি অনুযায়ী ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ প্রতি বছর গড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা করে লোকসান গুনতে হচ্ছে সরকারকে। গত এক দশকের বেশি সময়ে অলস বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে দেয়া এ অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৪ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা।

ঘাটতি মেটাতে বিপিডিবিকে ভর্তুকি দেয়া হয়েছে ৫৬ হাজার ৬২২ কোটি টাকা। এর পরও এক দশকে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে নয়বার। এতে বিদ্যুতের গড় দাম বেড়ে গেছে প্রায় ৯১ শতাংশ। যদিও এক দশকের মধ্যে কয়েকবার বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় কমেছে। এর মধ্যে গত দুই বছর টানা কমছে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়। তবে এর কোনো প্রভাব নেই বিদ্যুতের দামে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুৎ খাতে লোকসান ও দাম বাড়ার পেছনে রয়েছে মূলত দুটি কারণ। এর প্রথমটি হলো অদক্ষ উৎপাদন ব্যবস্থা। এতে সক্ষমতার অর্ধেকের বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রাখতে হচ্ছে। দ্বিতীয় কারণটি হলো বেসরকারি খাতে বিশেষত রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের উচ্চ ক্যাপাসিটি চার্জ। এ চার্জকে যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনলে বিদ্যুৎ খাতে লোকসান অনেক কমে যেত।

শুধু রেন্টাল-কুইক রেন্টালই নয়, আরো অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্রেরই প্রয়োজন নেই—এমন মন্তব্য করে কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, এ প্রয়োজন এসেছে মূলত ব্যবসায়ীদের স্বার্থে। ভর্তুকির অধিকাংশ যাচ্ছে বেসরকারি বিদ্যুৎ খাতে। উৎপাদনে না থাকা প্লান্ট ও ক্যাপাসিটি চার্জের কারণে ভর্তুকি বেড়েছে। উৎপাদনক্ষমতা আছে, অথচ উৎপাদনে নেই। এতে প্রডাকশন কস্ট বাড়ছে, ভর্তুকিও বেড়ে গেছে। পাশাপাশি বেড়েছে বিদ্যুতের দামও।

তিনি বলেন, ১০ শতাংশ চাহিদার প্রবৃদ্ধি হবে ধরে নিয়ে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয় ইউনিটপ্রতি প্রায় ৪৮ পয়সা। কিন্তু বাস্তবে চাহিদার প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র দেড় শতাংশ। এতে ভোক্তাদের কাছ থেকে ৪-৫ হাজার কোটি টাকা বেশি আদায় করা হয়েছে। সে অর্থ সমন্বয় করতে বলা হলেও সরকার তা করেনি।

এদিকে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী সম্প্রতি জাতীয় সংসদে জানিয়েছেন, গত ১০ বছরে সরকার বিদ্যুৎ খাতে ৫২ হাজার ২৬০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে। ভর্তুকির অর্থ গেছে ব্যবসায়ীদের অলস বিদ্যুৎকেন্দ্রের পেছনে। আর বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে সরকার বাকি অর্থের সমন্বয় করেছে। গত ১০ বছরে সরকার সাতবার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে।

সচিবালয়ে এক অনুষ্ঠানে তিনি জানান, বিদ্যুতের মাস্টারপ্ল্যান রিভিউ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সরকারের বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র সময়মতো চালু করতে না পারায় রেন্টাল প্রকল্পগুলোর মেয়াদ বাড়ানো হয়েছিল। চাহিদার কথা মাথায় রেখেই রেন্টাল প্রকল্পগুলো চালু রাখা হয়েছে। তবে আগামী বছরের মধ্যে অধিকাংশ রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বন্ধ করে দেয়া হবে। নো ইলেকট্রিসিটি নো পেমেন্ট ভিত্তিতে দু-একটি গ্যাসভিত্তিক রেন্টাল কেন্দ্র থাকবে।

Related Posts

বিপিসির ডিজেল বিক্রিতে দৈনিক লোকসান প্রায় ৯০ কোটি টাকা

FERB

রপ্তানি করা যাবে বিদ্যুৎ বাধা সঞ্চালন লাইন

FERB

সংকট বড় হচ্ছে জ্বালানিতে

FERB