রাশিয়ার গাজপ্রম যে কোম্পানিকে দিয়ে ঠিকায় কাজ করায়, তারাই ২৪% কম ব্যয়ে কূপ খননের প্রস্তাব দিয়েছে।
-
-
ভোলায় গাজপ্রম তিন কূপ খননের কাজ পাচ্ছে ৫৪০ কোটি টাকায়।
-
এরিয়েল খননের প্রস্তাব দিয়েছে ৪০৮ কোটি টাকা ব্যয়ে।
-
বাপেক্স করলে তিন কূপে খরচ পড়তে পারে ২৪০ কোটি টাকা।
-
রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি গাজপ্রমকে ভোলায় তিনটি গ্যাসকূপ খননের কাজ দিতে গিয়ে ১৩২ কোটি টাকা লোকসানের মুখে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ। দেশে গাজপ্রম কাজ পেলেও তারা নিজেরা কূপ খনন করে না। ঠিকা দেয় এরিয়েল অয়েল ফিল্ড সার্ভিসেস নামের একটি কোম্পানিকে। এরিয়েল বাংলাদেশ সরকারকে একই কূপ ২৪ শতাংশ কম খরচে খনন করে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। অবশ্য সরকারি সংস্থা বাপেক্সকে খননের কাজ দিলে খরচ পড়বে অর্ধেকের কম।
জ্বালানিসচিবের নেতৃত্বাধীন প্রস্তাব প্রক্রিয়াকরণ কমিটি (পিপিসি) গত ৯ সেপ্টেম্বর ভোলায় রাশিয়ার গাজপ্রমকে তিনটি কূপ খননের প্রাথমিক অনুমতি দেয় বলে জ্বালানি বিভাগের দুজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান। এখন শুধু জ্বালানিমন্ত্রী হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুমোদন বাকি। প্রতিটি কূপ খননে গাজপ্রম পাবে ১৮০ কোটি টাকা, তিনটিতে মোট ৫৪০ কোটি টাকা। অন্যদিকে এরিয়েল চিঠি দিয়ে বলেছে, তারা প্রতিটি কূপ ১৩৬ কোটি টাকা করে তিনটি মোট ৪০৮ কোটি টাকায় খনন করতে চায়।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রডাকশন কোম্পানি লিমিটেড (বাপেক্স) প্রতিটি কূপ খননে ৬৫ থেকে ৮০ কোটি টাকা ব্যয় করে। চলতি বছরই কুমিল্লার মুরাদনগরের শ্রীকাইলে একটি কূপ খনন শেষ করেছে বাপেক্স। এতে ৮০ কোটি টাকা ব্যয় হয়। এ হিসেবে, ভোলার তিনটি কূপ বাপেক্স খনন করলে ব্যয় হতো ২৪০ কোটি টাকা। সরকারের সাশ্রয় হতো ৩০০ কোটি টাকার মতো (গাজপ্রমের তুলনায়)।
ভোলা গ্যাসক্ষেত্র বাপেক্সই ১৯৯৫ সালে আবিষ্কার করে। সেখান থেকে সংস্থাটি ২০০৯ সাল থেকে গ্যাস উত্তোলন করছে, যা শুধু ভোলায় ব্যবহৃত হয়। ভোলায় এখন পর্যন্ত ছয়টি কূপ খনন করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সরকার রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা পিজেএসসি গাজপ্রমকে ২০১২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ১৭টি কূপ খননের কাজ দিয়েছে। এ জন্য ব্যয় হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। কূপগুলো এরিয়েলকে দিয়েই খনন করিয়েছে গাজপ্রম। রাশিয়ার গাজপ্রম অবশ্য সরাসরি কাজ এরিয়েলকে দেয় না। তারা দেয় গাজপ্রম ইপি ইন্টারন্যাশনালকে, যেটি নেদারল্যান্ডসে নিবন্ধিত। গাজপ্রম ইন্টারন্যাশনাল আবার কাজটি দেয় এরিয়েলকে।
এভাবে কূপ খননকাজের হাতবদল এবং বাংলাদেশের ব্যয় বৃদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। এ বিষয়ে জ্বালানিসচিব মো. আনিছুর রহমান ১৭ অক্টোবর মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশে যে গাজপ্রম এত দিন কাজ করেছে, ভোলায়ও কাজ করতে যাচ্ছে, তারা রাশিয়ার সরকারি গাজপ্রম বলেই আমরা জেনে এসেছি। গাজপ্রমের সঙ্গে আলোচনার সময় রাশিয়ার দূতাবাসের কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন।’ তিনি এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘এরিয়েলের কোনো প্রস্তাবের কথা আমি জানি না।’
এরিয়েলের প্রস্তাব
২০১২ সালে গাজপ্রম ইন্টারন্যাশনাল চুক্তি করে এরিয়েল অয়েল ফিল্ড সার্ভিসেসের সঙ্গে। চুক্তিতে বলা হয়, বাংলাদেশে যত গ্যাসকূপ খননের কাজ গাজপ্রম পাবে, তা এরিয়েল খনন করে দেবে। চুক্তির পর বাংলাদেশে গ্রাজপ্রমের পাওয়া ১৭টি কূপ খননের কাজ করে এরিয়েল।
ভোলার তিন কূপ (টগবি-১, ভোলা উত্তর-২ ও ইলিশা-১) খননের বিষয়ে গত ১৪ জুলাই পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান, বাপেক্সের এমডিসহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে চিঠি দেন এরিয়েলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আকমেদভ দিলশদ। তিনি ৪ কোটি ৮০ লাখ মার্কিন ডলারে (৪০৮ কোটি টাকা) সরাসরি কূপ তিনটি খননের প্রস্তাব দেন। এর মানে হলো, গাজপ্রম ইন্টারন্যাশনাল কাজ পেলে এরিয়েলকে দিয়ে খনন করিয়ে এই তিন কূপের বিপরীতে ১৩২ কোটি টাকা নিয়ে যাবে শুধু কমিশন হিসেবে।
চিঠিতে আকমেদভ দিলশদ বলেন, ‘আমরা বুঝি, এখন যেকোনো প্রকল্পে ব্যয় যতটা সম্ভব সাশ্রয়ী হওয়া উচিত। কারণ, মহামারির কারণে বিশ্ব অর্থ সাশ্রয়ের পথ খুঁজছে, যাতে করোনার বিরুদ্ধে লড়াই ও অনিশ্চিত পরিস্থিতির জন্য অর্থ রাখা যায়।’
এর আগে ২০১৮ সালেও ভোলায় তিনটি কূপ খননের কাজ দেওয়া হয় গাজপ্রমকে। সর্বশেষ কূপপ্রতি গাজপ্রম পেয়েছিল ১৪০ কোটি টাকা। এবার তা বাড়িয়ে ১৮০ কোটি টাকা ধরা হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকার যে সিদ্ধান্ত নেবে, আমরা সেটি পালন করব।’ তিনি এর বেশি কিছু বলতে রাজি হননি।
কাজ হাতবদল
২০১০ সালে রাশিয়া সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লামিদির পুতিনের কাছে বাংলাদেশে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উন্নয়নে সহযোগিতা চান। তখন একটি ‘প্রটোকল’ চুক্তি সই হয়। সেখানে রাশিয়ার কোনো সুনির্দিষ্ট কোম্পানির নাম ছিল না। রাশিয়া পরে তাদের কোম্পানি গাজপ্রমকে এ কাজে নিযুক্ত করে। ২০১১ সালের ৮ আগস্ট গাজপ্রম পেট্রোবাংলার কাছে বিনা দরপত্রে ১০টি কূপ খননের বাণিজ্যিক প্রস্তাব দেয়। প্রথম দফায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনের আওতায় গাজপ্রমকে ওই ১০ কূপ খননের কাজ দেওয়া হয়। এরপর তারা আরও ৭টি কূপ খননের কাজ পায়। গাজপ্রম সব কাজ গাজপ্রম ইন্টারন্যাশনাল দিয়ে দিচ্ছে। গাজপ্রম ইন্টারন্যাশনালের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, এটি রাশিয়ার বাইরে গাজপ্রমের প্রকল্প বাস্তবায়নের একক প্রতিষ্ঠান।
২০১৮ সালের ৩০ আগস্ট বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় ভোলার অন্য তিনটি কূপ খননের কাজ দেওয়ার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সম্মতির জন্য সারসংক্ষেপ পাঠায়। এতে বলা হয়, রাশিয়া ফেডারেশনের রাষ্ট্রীয় সংস্থা গাজপ্রমের মাধ্যমে কূপগুলো খনন করা হবে। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, সুনির্দিষ্টভাবে সরকারি অনুমতিপত্রে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংস্থা গাজপ্রমকে দিয়ে কাজ করানোর বিষয় উল্লেখ থাকলে নেদারল্যান্ডসে নিবন্ধিত গাজপ্রমকে কার্যাদেশ দিতে পারে না বাপেক্স। এটি সরকারি নির্দেশের লঙ্ঘন।
বাপেক্সের মহাব্যবস্থাপক পর্যায়ের দুই কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, রাশিয়ার সরকারি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে নেদারল্যান্ডসে নিবন্ধিত কোম্পানিকে কাজ দেওয়া নিয়ে ২০১৬ সালে একবার প্রশ্ন উঠেছিল। তখন বাপেক্সের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আতিকুজ্জামানকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
বাংলাদেশে তেল-গ্যাস উত্তোলনের কাজ কেন নেদারল্যান্ডসে নিবন্ধিত গাজপ্রম ইন্টারন্যাশনাল পায়, এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির (গাজপ্রম ইন্টারন্যাশনাল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সের্গেই তুমানবকে গত ২৯ সেপ্টেম্বর ও ১ অক্টোবর প্রথম আলোর পক্ষ থেকে ই-মেইল করা হয়। তিনি গতকাল শনিবার বিকেল পর্যন্ত জবাব দেননি। পাশাপাশি তাঁকে গত ৬ ও ১২ অক্টোবর হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে বার্তা পাঠানো হয়। তিনি বার্তাটি দেখেছেন (প্রযুক্তির ভাষায় সিন করা বলে)। তবে জবাব পাওয়া যায়নি।
কমিশন এজেন্টদের স্বার্থ রক্ষার জন্য এভাবে সরকারি কোম্পানির নামে অন্যদের কাজ দেওয়া হচ্ছে। এখানে রাশিয়ার সরকারি কোম্পানি গাজপ্রমকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে একটি গোষ্ঠী।বদরূল ইমাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক বদরূল ইমাম প্রথম আলোকে বলেন, কমিশন এজেন্টদের স্বার্থ রক্ষার জন্য এভাবে সরকারি কোম্পানির নামে অন্যদের কাজ দেওয়া হচ্ছে। এখানে রাশিয়ার সরকারি কোম্পানি গাজপ্রমকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে একটি গোষ্ঠী।
পাঁচ কূপের টাকা জলে
২০১৬ সালের ১৭ নভেম্বর পেট্রোবাংলাকে দেওয়া বাপেক্সের এক প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, গাজপ্রমের খননকৃত ১৭টি কূপের মধ্যে পাঁচটিতে গ্যাস তোলা শুরুর কিছুদিন পরেই পানি ও বালু উঠে উত্তোলন বন্ধ হয়ে যায়। এগুলো হলো সেমুতাং ৬, বেগমগঞ্জ ৩, শাহবাজপুর ৪, তিতাস ২১ ও তিতাস ২০। এই পাঁচ কূপ খননে গাজপ্রম ইন্টারন্যাশনালকে তখন দেওয়া হয়েছিল প্রায় ৮৫৩ কোটি টাকা। পরে পাঁচটি কূপ বাপেক্স আবার খনন করে গ্যাস উত্তোলন করে। গাজপ্রমকে দেওয়া টাকা জলে যায়। এ জন্য গাজপ্রমকে দায়ী করা যায়নি; কারণ, চুক্তিতে দুর্ঘটনা ও কূপ খননের পরবর্তীকালে কোনো সমস্যা দেখা দিলে তার দায় কে নেবে, এমন কোনো বিষয় ছিল না। এবারও গাজপ্রম ইন্টারন্যাশনাল একই শর্তে কাজ পেতে যাচ্ছে।
বাপেক্সের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মর্তুজা আহমেদ ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, গাজপ্রমের কাজের মান ভালো ছিল না। কূপগুলো থেকে কাঙ্ক্ষিত ফলও আসেনি। তা ছাড়া কূপ খননে গাজপ্রমের ব্যয়ের অর্ধেকে বাপেক্স করতে পারে। তাদের কাজের মানও ভালো। বাপেক্স আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রে শুধু গাজপ্রম নয়, কোনো বিদেশি প্রতিষ্ঠানকেই দেওয়া উচিত নয়।
বাপেক্সের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মর্তুজা আহমেদ ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, গাজপ্রমের কাজের মান ভালো ছিল না। কূপগুলো থেকে কাঙ্ক্ষিত ফলও আসেনি। তা ছাড়া কূপ খননে গাজপ্রমের ব্যয়ের অর্ধেকে বাপেক্স করতে পারে। তাদের কাজের মানও ভালো। বাপেক্স আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রে শুধু গাজপ্রম নয়, কোনো বিদেশি প্রতিষ্ঠানকেই দেওয়া উচিত নয়।