Forum for Energy Reporters Bangladesh
Image default
Bangla News

কয়লা নয়, এলএনজি বিদ্যুতের পরিকল্পনা

তেলের তুলনায় কয়লার বিদ্যুৎকেন্দ্র সাশ্রয়ী। ফলে তেল-গ্যাসের বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সরে মিশ্র জ্বালানির বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে ঝুঁকে পড়ে সরকার। দেশি ও আন্তর্জাতিক পরিবেশবাদীদের বিরোধিতা, নানা যুক্তিতর্ককে উপেক্ষা করে প্রায় ২৩ হাজার মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি হয়। বিদ্যুৎ বিভাগ এখন কয়লার বিদ্যুৎ থেকে সরে আসতে চাইছে। চুক্তির নানা শর্তভঙ্গের দায়ে এবং সময়মতো উৎপাদনে আসতে না পারার কারণে অধিকাংশ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে চুক্তি বাতিলের প্রক্রিয়া নিয়েছে। ইতোমধ্যে অনুমোদন দেওয়া অনেক কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রকে উৎপাদনে আসতে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। একই সঙ্গে অদূর ভবিষ্যতে লিকুইড ন্যাচারাল গ্যাস (এলএনজি) ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বৃদ্ধির পরিকল্পনাও নেওয়া হচ্ছে।

বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের সঙ্গে কথা বললে তিনি আমাদের সময়কে বলেন, ‘সরকার মানুষকে সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ সরবরাহে অব্যাহত চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রাথমিক জ্বালানি আমদানিনির্ভর। কয়লা বা এলএনজি দুটোই আমদানি করতে হয়। ফলে যে জ্বালানির ওপর নির্ভর করলে সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে, সরকার সেটিই বিবেচনা করবে।

কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সরে আসার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘অনেক কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র কয়েক দফা সময় বাড়িয়েও সময়মতো উৎপাদনে আসতে পারেনি। এদের বিষয়ে চুক্তি অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

বিদু্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রাথমিক জ্বালানি সহজলভ্য এবং টেকসই জ্বালানির মিশ্রণ বিবেচনায় বিদ্যুৎ উৎপাদন পরিকল্পনা বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের পরামর্শক সংস্থা পাওয়ার সেল সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন করেছে। সেখানে বলা হয়, ২০০৯ সালের পর সরকারি-বেসরকারি যেসব কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল এবং চুক্তি অনুযায়ী সেসব সময়মতো উৎপাদনে আসতে পারেনি। বিশেষ করে যেসব প্রকল্পে তিন থেকে সাত বছরের মধ্যেও কোনো অগ্রগতি নেই, সেসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করা দরকার। একই সঙ্গে পাওয়ার সেলের সুপারিশে দেখা যায় পায়রায় বিদ্যমান ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র ছাড়া পরিকল্পনাধীন এবং নির্মাণাধীন অন্য কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোও বাতিল করার সুপারিশ করা হয়েছে।

পাওয়ার সেল তাদের প্রতিবেদনে দেখিয়েছে, এক হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য জমি দরকার প্রায় ৭০০ একর। অথচ একই পরিমাণ একটি এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য জমি দরকার হয় মাত্র ৪০ থেকে ৫০ একর। এ ছাড়া কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে আমদানি করা কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে প্রতি ইউনিটের দাম পড়ে সাড়ে ৭ থেকে ৮ টাকার মধ্যে, আর স্থানীয় কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে দাম পড়ে সাড়ে ৮ টাকা। কিন্তু দেশীয় গ্যাসের সঙ্গে ব্লেন্ডিং করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়ে সাড়ে ৫ থেকে ৬ টাকার মধ্যে। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ইফিসিয়েন্সি বা দক্ষতা ৪১ থেকে ৪৪ শতাংশ। অন্যদিকে এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ইফিসিয়েন্সি ৫৮ থেকে ৬০ শতাংশ। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে পরিবেশগত ক্ষতির পরিমাণ বা পরিবেশগত ব্যয় ১২১ মিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে এলএনজি পুরোপুরি ক্লিন ফুয়েল। পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লা পরিবহন ব্যয় প্রতি টন ২৫ ডলার। এলএনজি গ্যাস পাইপলাইনে বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা যায়।

পাওয়ার সেল প্রতিবেদন আরও বলছে, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে পরিবেশগত ক্ষতি হয়। বিশ্বব্যাপী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নেগেটিভ প্রচারণা রয়েছে। এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের তুলনায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে জমির পরিমাণ দরকার হয় ১৫ গুণ। সবদিক বিশ্লেষণ করে পাওয়ার সেল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সরে আসতে পরামর্শ দিয়েছে সরকারকে।

২০০৯ সালের আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ব্যাপক হারে বিদ্যুৎ উৎপাদন পরিকল্পনা নেওয়া হয়। ২০০৯ সালে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। যার ৯০ শতাংশ ছিল দেশীয় উৎপাদিত গ্যাস। পরে পর্যায়ক্রমে গ্যাসের উৎপাদন কমতে থাকায় সরকার দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বহুমুখীকরণের উদ্যোগ নেয়। পরিকল্পনা করা হয় ২০২১ সালের মধ্যে ২৪ হাজার মেগাওয়াট, ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের। এ পরিকল্পনায় গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বাইরে সাশ্রয়ী জ্বালানি বিদ্যুৎকেন্দ্র বিবেচনায় কয়লাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যান (পিএসএম-২০১০) সালের পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে উৎপাদিত মোট বিদ্যুতের ৫০ শতাংশ কয়লা থেকে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের ৫০ শতাংশের মধ্যে ২৫ শতাংশ দেশি কয়লা এবং ২৫ শতাংশ আমদানিনির্ভর কয়লা থেকে। পিএসএমপি-২০১০ অনুযায়ী সরকার জাপান ইন্টারন্যাশনাল করপোরেশন (জাইকা) সহায়তায় কক্সবাজারের মাতারবাড়ী, ভারতের এনটিপিসির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র, চীনের সঙ্গে পায়রায় বিদ্যুৎ হাব, মহেশখালী বিদ্যুৎ হাবসহ সরকারি-বেসরকারি খাতে দুই ডজনের বেশি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেয়।

পরবর্তীকালে নতুন করে পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যান (পিএসএমপি-২০১৬) প্রণয়ন করা হয়। সেখানে দেশি গ্যাসের বিকল্প হিসেবে বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানি, আঞ্চলিক, উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার মাধ্যমে বিদেশ থেকে বিদ্যুৎ আমদানি এবং পারমাণবিকভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। ২০১৬ সালের মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী পরিকল্পনা করা হয়েছিল গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ৩৫ শতাংশ, কয়লাভিত্তিক ৩৫ শতাংশ, আমদানিনির্ভর বিদ্যুৎ ১৫ শতাংশ, পারমাণবিকভিত্তিক ১০ শতাংশ ও তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ ৫ শতাংশ হারে উৎপাদন করা হবে। তবে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যাপক পরিকল্পনা করা হলেও অধিকাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।

এ পর্যন্ত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে ১ হাজার ১৫৭ মেগাওয়াট। বড়পুকুরিয়া থেকে ৫২৫ মেগাওয়াট এবং পায়রার প্রথম ইউনিট ৬২২ মেগাওয়াট। এখনো সরকারি-বেসরকারি খাতে প্রায় ২২ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাস্তবায়নাধীন। এখন সরকার চাইছে অধিকাংশ কেন্দ্রের সঙ্গেই চুক্তি বাতিল করতে।

কয়লাভিত্তিক সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে রয়েছে রামপাল মৈত্রী সুপার ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট থার্মাল বিদ্যুৎকেন্দ্র; মাতারবাড়ীর ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট; পায়রা পটুয়াখালী ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট (প্রথম ফেস); পটুয়াখালী ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট (আরপিসিএল); পায়রা পটুয়াখালী ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট (দ্বিতীয় ফেস); আশুগঞ্জ ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট; উত্তরবঙ্গ সুপার থার্মাল ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট; কোহেলিয়া ৭০০ মেগাওয়াট; মাতারবাড়ী ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট (জাপান); মহেশখালী ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট (চায়না); মহেশখালী ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট (পিডিবি); মহেশখালী ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট (মালয়েশিয়া); মহেশখালী ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট (চায়না); মহেশখালী ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট (কোরিয়া)। আর বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রাম ১ হাজার ২২৪ মেগাওয়াট (এসএস পাওয়ার); বরিশাল ইলেকট্রিক পাওয়ার কোম্পানির বরিশাল ৩০৭ মেগাওয়াট; ওরিয়ন ঢাকা পাওয়ার কোম্পানির মুন্সীগঞ্জ ৫২২ মেগাওয়াট; একই কোম্পানির ঢাকা ৬৩৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র (মুন্সীগঞ্জের চরবলাকি মেঘনাঘাট); ঢাকা ২৮২ মেগাওয়াট; চট্টগ্রাম ২৮২ মেগাওয়াট; মিরসরাই ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট আইপিপি বিদ্যুৎকেন্দ্র।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, পাওয়ার সেল যে প্রতিবেদন তৈরি করেছে সেখানে দেখা যায়- পায়রায় কয়লার হাব তৈরির যে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়, সেটা বাস্তবায়ন বিরাট চ্যালেঞ্জ। প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য লাখ লাখ টন কয়লা বিদেশ থেকে আমদানি করতে হবে। এসব কয়লা পরিবহনে নদী ও সমুদ্রের নাব্যতা বজায় রাখতে সারাবছর ড্রেজিং করতে হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, আমদানি করা ১ লাখ ৬০ হাজার টন ধারণক্ষমতার কয়লার জাহাজ নাব্যতা সংকটে বন্দরে পৌঁছানো যায়নি। গভীর সমুদ্রে নোঙর করে রাখতে হয়েছে। পরে সেখান থেকে ছোট ছোট জাহাজে করে ৮ থেকে ১০ হাজার টন লাইটার জাহাজে কোল ইয়ার্ডে পৌঁছাতে হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল আলম আমাদের সময়কে বলেন, আমাদের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের পরিকল্পনা দেখলেই স্পষ্ট বোঝা যাবে এসব পরিকল্পনা দীর্ঘমেয়াদি বা সুদূরপ্রসারী নয়। ফলে বারবার পরিকল্পনা বদলাতে হয়। একসময় একের পর এক কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দিয়েছে। এখন আবার সরে আসতে চাচ্ছে। আমাদের আগে নির্ধারণ করা উচিত কতটুকু বিদ্যুৎ দরকার। সেই নির্ধারণের জায়গাটাও খামখেয়ালিভাবে তৈরি করা হয়েছে।

Related Posts

তেল-গ্যাস অনুসন্ধান উন্মুক্ত করার চিন্তা

FERB

প্রধানমন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে গ্যাস সংযোগ, তদন্তের নির্দেশ

FERB

গোপনে চলছে গ্যাস উন্নয়ন তহবিলের অপারেশন

FERB