বাংলাদেশের সমুদ্রে গ্যাসসম্পদ অনুসন্ধান কাজ বারবার হোঁচট খাচ্ছে। ২০১২ এবং ২০১৪ সালে প্রতিবেশী দুই দেশ ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ মীমাংসা হয়। আন্তর্জাতিক সালিশ আদালতের রায়ে বিশাল সমুদ্র এলাকা পেয়েছে বাংলাদেশ। সমুদ্র বিরোধ নিষ্পত্তির পর ভারত ও মিয়ানমার তাদের সমুদ্র এলাকা থেকে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান করে তা ব্যবহার করলেও বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত ঠিকমতো জরিপকাজই শেষ করতে পারেনি। নানা প্রচেষ্টায় চারটি বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে পেট্রোবাংলা। এর মধ্যে অনেক আগেই চুক্তি বাতিল করে চলে গেছে মার্কিন কোম্পানি কনোকো ফিলিপস। গত কয়েক বছর কাজ করছিল অস্ট্রেলিয়ান কোম্পানি সান্তোস ও দক্ষিণ কোরিয়ার পস্কো দাইয়ু। তারাও কাজ না করে দেশ ছেড়ে চলে যেতে চাইছে।
দক্ষিণ কোরিয়ান কোম্পানি পস্কো দাইয়ু সরকারের কাছে দাবি করেছে চুক্তির বাইরে গিয়ে গ্যাসের দাম বাড়াতে হবে। অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়ান কোম্পানি সান্তোস চলে যেতে চায়। কোম্পানি দুটি গত মাসে পেট্রোবাংলাকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে তারা চুক্তি বাতিল করে চলে যাবে।
জ্বালানি বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আনিসুর রহমানের সঙ্গে কথা বললে তিনি আমাদের সময়কে বলেন, কোনো কোম্পানি যদি চলে যেতে চায়, তবে তাকে তো জোর করে আটকে রাখা যাবে না। সান্তোস চুক্তি বাতিল করার চিঠি দিয়েছে। পেট্রোবাংলার চুক্তি অনুযায়ী তাদের ব্যাংক সিকিউরিটি জমা রাখা ১ কোটি ১০ হাজার মার্কিন ডলার বাজেয়াপ্ত করব। সচিব বলেন, আমরা যতটুকু জানতে পেরেছি, তারা শুধু আমাদের এখানে নয়; বিভিন্ন দেশ থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছে। এ ছাড়া দক্ষিণ কোরিয়ার কোম্পানি দাইয়ুর চলে যাওয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, আগের পিএসসি অনুযায়ী চুক্তি করা হয়েছিল। এখন তারা নতুন প্রোডাকশন শেয়ারিং কন্ট্রাক্ট (পিএসসি) বা উৎপাদন-বণ্টন চুক্তি অনুযায়ী গ্যাসের দাম বাড়াতে চাচ্ছে। এই দাবি পূরণ সহজ কাজ নয়। এক পিএসসি অনুযায়ী চুক্তির পর অন্য পিএসসি অনুযায়ী গ্যাসের দাম বাড়ানো যায় না। তবে যতটুকু জেনেছি, তারা বিনিয়োগ পাচ্ছে না। ফলে চলে যেতে চায়। জ্বালানি সচিব বলেন, এখন সমুদ্রে কাজ করার বিদেশ কোম্পানি থাকল ভারতীয় কোম্পানি ওএনজিসি। তাদের দুই বছর সময় বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, করোনার ভয়াবহ প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতি চরম ক্ষতিগ্রস্ত ও বিপন্ন। মুখ থুবড়ে পড়ছে বিশ্বের অর্থনীতি। সেই প্রভাব ব্যাপক আকারে পড়েছে জ্বালানি খাতেও। এমনিতেই বাংলাদেশের জ্বালানি আমদানিনির্ভর। দেশের নিজস্ব জ্বালানি বলতে গ্যাস। কয়লা থাকলেও তার ব্যাপক ব্যবহার শুরু করা যায়নি। গভীর সমুদ্র ও স্থলভাগে তেল-গ্যাস বা খনিজসম্পদের ব্যাপক অনুসন্ধানে দীর্ঘ সময় ধরেই বলে আসছেন বিশেষজ্ঞরা। গত সেপ্টেম্বরের মধ্যে আন্তর্জাতিক দরপত্র প্রক্রিয়ার যে প্রস্তুতি ছিল করোনার কারণে চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এ অবস্থায় দীর্ঘ সময়ের জন্য ঝুলে গেছে সমুদ্রসহ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ তেল-গ্যাস অনুসন্ধান প্রক্রিয়া। সর্বশেষ সমুদ্রে চলমান কাজ রেখে দুটি কোম্পানির দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা হচ্ছে বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে আরও বড় ধাক্কা।
সমুদ্র গ্যাস অনুসন্ধানের দরপত্র কবে প্রকাশ হতে পারে জানতে চাইলে সচিব বলেন, এখন ঠিক বলা যাবে না। আমাদের সব প্রস্তুতি রয়েছে। এমন সময় দরপত্র আহ্বান করতে চাই, যখন বিশ্বব্যাপী সাড়া পড়বে। বিদেশি খ্যাতিমান কোম্পানিগুলো দরপত্রে অংশগ্রহণ করবে।
পেট্রোবাংলার এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, কোভিড-১৯ বা করোনার কারণে জ্বালানি তেলের দাম বিশ্বব্যাপী কমে গেছে। তেলের দামের সঙ্গে সব সময় গ্যাসের দামের হিসাব করা হয়। আন্তর্জাতিক তেল-গ্যাস উত্তোলনকারী কোম্পানিগুলো বিশ্ববাজারে তেলের দামের সঙ্গে সমন্বয় করে ব্যবসা সম্প্রসারণ বা সংকোচন করে। এ পরিস্থিতিতে জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ পাওয়া অনেক কঠিন। ফলে ভালো দামও দিতে পারবে না কোম্পানিগুলো। এতে সব দিক থেকেই একটি সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ দরপত্র আহ্বান করলেও ভালো ফল না পাওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। চুক্তি করার পরও বিদেশি কোম্পানিগুলোর দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার কারণ হিসেবে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দাকে দায়ী করেন।
এদিকে জ্বালানি খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনায় বাংলাদেশের সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের অনেক দিনের যে প্রচেষ্টা বড় ধরনের ধাক্কা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে করোনা। এ ছাড়া এ মুহূর্তে দুটি বিদেশি কোম্পানির দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া হবে আরও বড় ধাক্কা।
পেট্রোবাংলার উপমহাব্যবস্থাপক শাহনেওয়াজ পারভেজ আমাদের সময়কে বলেন, একটি কোম্পানি পুরো এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চল থেকেই ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছে। আরেকটি কোম্পানি অযৌক্তিক গ্যাসের দাম বাড়াতে বলছে। এখন এসব ব্লকের কী হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এসব ব্লক পরবর্তী দরপত্রের মাধ্যমে দিয়ে দেওয়া হবে।
পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, পস্কো দাইয়ু সমুদ্রে ডিএস-১২ ব্লকে প্রথম ফেজে কিছু কাজ করেছে। কিন্তু দ্বিতীয় ফেজে কাজ করবে না। এই ব্লকে এর আগে কোম্পানিটি তিন হাজার ৫৮০ কিলোমিটার দ্বিমাত্রিক জরিপ করে ডেটা পেট্রোবাংলার কাছে জমা দিয়েছে। এই ব্লকটি খুবই সম্ভাবনাময়। পাশেই মিয়ানমার তাদের ব্লক থেকে গ্যাস তুলছে। এ ছাড়া সান্তোস এসএস-১১ ব্লকে তিন হাজার ২০০ কিলোমিটার দ্বিমাত্রিক জরিপ করেছে। এ ছাড়া ৩০২ বর্গকিলোমিটার ত্রি-মাত্রিক জরিপ করে ডেটা পেট্রোবাংলার কাছে দিয়েছে। একটি কূপ খনন করার কথা ছিল সেটি হচ্ছে না।
এদিকে পস্কো দাইয়ু ও সান্তোস চলে যাওয়ার পর সমুদ্রে কাজ করার একমাত্র বিদেশি কোম্পানি থাকবে ভারতের প্রতিষ্ঠান ওএনজিসি বিদেশ লিমিটেড। অগভীর সাগরের ৪ ও ৯ নম্বর ব্লকে কাজ করছে তারা। চলতি বছর তাদের সমুদ্রে কূপ খনন করার কথা থাকলেও সরকারের কাছে আরও দুই বছর সময় বাড়ানোর আবেদন করেছে ওএনজিসি। জ্বালানি বিভাগ তা মঞ্জুরও করেছে। ফলে ২০২৩ সালের দিকে তারা সমুদ্রে কূপ খনন করবে।
সমুদ্র সীমানা বিরোধ নিষ্পত্তির ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও সমুদ্রসম্পদ আহরণে ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ। প্রতিবেশী দেশ ভারত, মিয়ানমার ও শ্রীলংকা তাদের সমুদ্রসম্পদ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে যুক্ত করছে। তেল ও গ্যাসসহ মূল্যবান খনিজসম্পদ তুলছে তারা। বাংলাদেশ এখনো পরিকল্পনার মধ্যেই আটকে আছে।
মিয়ানমার তাদের সমুদ্রের ব্লকগুলোয় অনুসন্ধান চালিয়ে গ্যাসের সন্ধান পেয়েছে। থালিন-এক নামক ব্লকে প্রায় পাঁচ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস প্রাপ্তির ঘোষণা দিয়েছে দেশটি। ওই ব্লক থেকে গ্যাস উত্তোলন শুরু করেছে মিয়ানমার। হাত গুটিয়ে বসে নেই ভারতও। কৃষ্ণা-গোদাভারী বেসিন এলাকায় ভারতের সরকারি প্রতিষ্ঠান ওএনজিসি, গুজরাট এস্টেট পেট্রোলিয়াম করপোরেশন, বেসরকারি গ্রুপ রিলায়েন্স কোম্পানির অনুসন্ধানে প্রায় ৫০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস মজুদের আশা করছে ভারত।
গত ২০১২ সালের ১৪ মার্চ আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতের রায়ে বাংলাদেশ-মিয়ানমার মামলায় প্রায় ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারেরও বেশি সমুদ্র এলাকার দখল পায় বাংলাদেশ। ২০১৪ সালের ৮ জুলাই বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার বিরোধপূর্ণ সমুদ্র সীমানায় ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গকিলোমিটারের অধিকার পায়।