Forum for Energy Reporters Bangladesh
Image default
Bangla News

গ্রিডলাইন নির্মাণকাজ হাতছাড়া পিজিসিবির

দেশের একমাত্র রাষ্ট্রীয় কোম্পানি পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও সরবরাহের কাজ করে থাকে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর কাজ শেষ হলে পিজিসিবি পাওয়ার এভাকেশন করে থাকে। তবে এবার পিজিসিবির অক্ষমতা বা সীমাবদ্ধতায় প্রথববারের মতো বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিসিপিসিএল) নামে ভিন্ন একটি বিদ্যুৎ উৎপাদক কোম্পানি গ্রিড লাইন নির্মাণের দায়িত্ব পেয়েছে- যে কোম্পানিটি মূলত বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে গঠিত। পটুয়াখালীতে নির্মাণাধীন পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার (দ্বিতীয় ফেজ) প্রকল্পের জন্য গ্রিড লাইন নির্মাণ করবে বিসিপিসিএল, যা ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন দিয়েছেন।

বাংলাদেশ নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি (এনডব্লিউপিজিসিএল) এবং চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশন (সিএমসি) মিলে গঠিত হয় বিসিপিসিএল। উভয়ে ৫০ শতাংশ করে সমান অংশীদারের ভিত্তিতে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের লক্ষ্যে বিসিপিসিএল গঠন করা হয়। এখন গ্রিড লাইন নির্মাণের কাজও করবে তারা। ২০১৪ সালে গঠিত কোম্পানি বিসিপিসিএল ইতোমধ্যে পায়রা কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র (প্রথম ফেজ) সফলতার সঙ্গেই শেষ করেছে।

বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্যানুযায়ী, গত ১০ বছরে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন দ্রুত গতিতে বেড়েছে। সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যে মাস্টারপ্ল্যান করেছে তাতে লক্ষ্য ২০৩০ সাল নাগাদ ৪০ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন সক্ষমতা তৈরি। ইতোমধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়িয়েছে ২৩ হাজার ৫৪৮ মেগাওয়াট (ক্যাপটিভসহ)। অর্থাৎ আগামী ১০ বছরের মধ্যে আরও প্রায় ১৭ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে চায়। লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে ইতোমধ্যে অনেক বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে।

সরকারের গত ১০ বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদনে অনেক সফলতার পরিচয় দিলেও পিছিয়ে পড়েছে বিদ্যুৎ সঞ্চালন, গ্রিড লাইন নির্মাণ ও বিতরণ ব্যবস্থা। বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন কোম্পানি কাজ করলেও বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণ প্রক্রিয়ার দায়িত্ব একমাত্র রাষ্ট্রীয় কোম্পানি পিজিসিবির। বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গ্রিড লাইন, সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন নির্মাণ করতে না পারায় পিজিসিবির ওপর দায় পড়ছে অনেক। অভিযোগ উঠেছে, বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ শেষ হলেও গ্রিড লাইন নির্মাণ জটিলতায় বসে থাকতে হচ্ছে রেডি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে। এর মাসুল গুনতে হয় শত শত কোটি টাকা গচ্চা দিয়ে। এ ছাড়া অদূরভবিষ্যতে আরও যেসব মেগা বিদ্যুৎ প্রকল্প উৎপাদনে আসবে, সেগুলোর বিদ্যুৎ যথাসময়ে গ্রিডে যুক্ত করতেও পিজিসিবির অন্য প্রকল্পগুলোও বাস্তবায়নে হিমশিম খাচ্ছে। ফলে নানা অজুহাতে এবার পিজিসিবির হাতছাড়া হয়ে গেছে গ্রিড লাইন নির্মাণ প্রকল্প।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, পায়রায় নির্মাণাধীন ১৩২০ মেগাওয়াট (দ্বিতীয় ফেজ) বিদ্যুৎ প্রকল্প, এলএনজি-ভিত্তিক ৩৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র ছাড়া নির্মাণাধীন আরও একাধিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদিত বিদ্যুৎ গ্রিডে সরবরাহ করতে ফিজিবিলিটি স্টাডি হয়েছে। পিজিসিবি থেকে বিদ্যুৎ বিভাগকে বলা হয়, পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াটের (দ্বিতীয় ফেজের) জন্য ‘পায়রা-গোপালগঞ্জ-আমিনবাজার ৪০০ কেভি ডাবল সার্কিট সঞ্চালন লাইন’ নির্মাণকাজ ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে মাঠপর্যায়ে শুরু করা যাবে। এ ছাড়া ২০২৪ সালের ডিসেম্বর নাগাদ সঞ্চালন লাইনটি কমিশনিং করা যাবে। ফলে বিসিপিসিএল নিজেরাই প্রস্তাবিত গ্রিড লাইন করতে আগ্রহ প্রকাশ করে। এ লক্ষ্যে বিসিপিসিএলের নিজস্ব বোর্ড অনুমোদন করে প্রস্তাবও দিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগে। বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে পাঠানো প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন দিয়েছে।

এ বিষয়ে এনডব্লিউপিজিসিএলের কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং বিসিপিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী খুরশেদ আলম আমাদের সময়কে বলেন, যে মেগা বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে তার মধ্যে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র অন্যতম। ইতোমধ্যে ফার্স্ট ফেজে ১৩২০ মেগাওয়াট তাপভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের গ্রিড লাইন নির্মাণ নিয়ে বেশকিছু জটিলতা ছিল। সেগুলো সময়মতো বাস্তবায়ন করতে পারেনি পিজিসিবি। এমন বাস্তবতায় পায়রা সেকেন্ড ফেজে আরেকটি ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। সেই বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য গ্রিড লাইন নির্মাণ করবে বিসিপিসিএল। তিনি বলেন, উদ্দেশ্য একটাই যেন সময়মতো গ্রিড লাইন নির্মাণ করা যায়। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় কোম্পানি পিজিসিবির ব্যর্থতা রয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি ব্যর্থতা বলব না। তবে পারিপাশির্^ক বাস্তবতায় নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে পিজিসিবির। বিসিপিসিএল কর্তৃক গ্রিড লাইন নির্মাণে ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন দিয়েছেন। ডিসেম্বরের মধ্যেই আমরা টেন্ডার আহ্বান করব।

এ বিষয়ে পিজিসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম কিবরিয়ার সঙ্গে কথা বলতে চেয়ে তাকে ফোন ও ক্ষুদে বার্তা প্রেরণ করা হলেও কথা বলা যায়নি। ফিরতি ক্ষুদে বার্তায় জানা যায় তিনি অসুস্থ আছেন।

গত বছর পটুয়াখালীর পায়রায় কয়লাভিত্তিক ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের নির্মাণকাজ শেষ হলেও বিদ্যুতের অভাবে তা পরীক্ষা করা যায়নি সময়মতো। পটুয়াখালী-পায়রা ৪৭ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণকাজ করতে সময় লেগেছে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে কয়েক মাস বেশি। গত বছরের মার্চ মাসে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রাথমিক পরীক্ষা শেষে একই বছরের ২৪ আগস্ট থেকে এ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে পরীক্ষামূলক সঞ্চালনের কথা ছিল। সময়মতো সেটা বাস্তবায়ন হয়নি। এ ছাড়া কেন্দ্রের বিদ্যুৎ গোপালগঞ্জ পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার জন্য যে সঞ্চালন লাইন নির্মাণকাজ চলছিল, সেটাও তখন সময়মতো শেষ হয়নি। ফলে কেন্দ্রের প্রথম ইউনিট এবং দ্বিতীয় ইউনিট দুটোই বেশ পিছিয়েছে নির্ধারিত সময়ের অনেক। ফলে সরকারের ক্ষতি হয়েছে কয়েকশ কোটি টাকা। প্রায় এক বছর পরে চলতি বছরের অক্টোবরে প্রথম ফেজের দ্বিতীয় ইউনিটের বিদ্যুৎ গ্রিডে সরবরাহ করা হয়েছে।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, পায়রা দ্বিতীয় ফেজ ১৩২০ মেগাওয়াট প্রকল্পটি পায়রা এক্সিম ব্যাংকের দেওয়া ঋণে বাস্তবায়ন করা হবে। ২০১৭ সালের ২০ মার্চ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন দেন। পরে গত বছরের ১৬ মে ইপিসি চুক্তি স্বাক্ষর হয়। চলতি বছরের ২৭ আগস্ট স্ট্যান্ডিং কমিটি অন নন-কনসেশনাল লোন অনুমোদন হয়। সূত্রে জানা যায়, প্রকল্পটির ফিন্যান্সিয়াল ক্লোজিংয়ের কাজও শেষ। ২০২৩ সালের জুনে প্রথম ইউনিট এবং একই বছরের ডিসেম্বরে দ্বিতীয় ইউনিট বাস্তবায়ন করতে চায় বিসিপিসিএল।

এদিকে রাষ্ট্রীয় কোম্পানি পিজিসিবিকে এড়িয়ে গিয়ে ভিন্ন একটি কোম্পানিকে গ্রিড লাইন নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়ায় সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা হিসেবে দেখছেন জ¦ালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. শাসমুল আলম। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, দেশে মাত্র ২০/২২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণে সরকারি একটি কোম্পানি রয়েছে পিজিসিবি। এখন প্রতিষ্ঠানটি যদি সময়মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে না পারে- সেটা কেন পারে না বা কী সমস্যা তা খুঁজে বের করে সমাধান করা সরকারেরই দায়িত্ব। তারা সময়মতো পারবে না এমন অজুহাতে অন্য কোম্পানিকে দায়িত্ব দেওয়া সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। বিদ্যুৎ উৎপাদন বেসরকারি মালিকদের নিয়ন্ত্রণে। এখন ক্রমান্বয়ে বিতরণ ব্যবস্থা, গ্রিড লাইনও বেসরকারিকরণে একটা প্রক্রিয়া চলছে বলা যায়। ড. শামসুল আলম বলেন, সরকারি কোম্পানি পিজিসিবি যদি না পারে, তবে সেখানে কারা দায়িত্বে আছে বা এতদিন কারা দায়িত্বে ছিল- সব দায়ভার তাদের। একটি বিশেষায়িত কোম্পানির কাজ অন্য কোনো কোম্পানিকে দেওয়া উচিত নয় বলে তিনি মন্তব্য করেন। বরং পিজিসিবিকে কী করে শক্তিশালী ও দক্ষ করা যায়, সেটাই দ্রুত বিবেচনায় নিয়ে সমাধান করা উচিত।

Related Posts

বিপজ্জনক ৪০ হাজার ডেথ গ্যাস সংযোগ

FERB

জ্বালানির দাম বৃদ্ধির কারণ গ্যাস অনুসন্ধানে ব্যর্থতা

FERB

৪৬ টাকার ডিজেল যেভাবে ৮০ টাকা

FERB