২০২১ সালের মধ্যে সবার ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়ার যে লক্ষ্য নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার কাজ শুরু করেছিল, তা এখন বাস্তবায়নের দ্বারপ্রান্তে। ইতোমধ্যে দেশের ৯৮ শতাংশ মানুষ বিদ্যুতের সুবিধা পাচ্ছে। প্রতিকূল পরিবেশে থাকা অবশিষ্ট ২ শতাংশ দ্বীপাঞ্চল, দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল এবং প্রত্যন্ত চরাঞ্চলের বাসিন্দা। বঙ্গোপসাগরের মোহনায় অবস্থিত দ্বীপগুলোকে বিদ্যুতের আওতায় আনতে সাগরের তলদেশ দিয়ে সাবমেরিন ক্যাবল স্থাপনের কাজ চলমান রয়েছে। প্রতিকূল পরিবেশ ও আর্থিক বিবেচনায় দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল এবং পদ্মা-মেঘনা-যমুনার প্রত্যন্ত চরাঞ্চালগুলোতে স্থাপন করা হচ্ছে আধুনিক সোলার হোম সিস্টেম। মুজিবর্ষেই অবশিষ্ট কাজ সম্পন্ন হবে বলে আশা প্রকাশ করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু সংবাদকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতি ‘সবার ঘরে বিদ্যুৎ’ যথাসময়ে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বিদ্যুৎ বিভাগ নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। আমরা ইতোমধ্যে ৯৮ শতাংশ মানুষকে বিদ্যুতের আওতায় আনতে পেরেছি। অবশিষ্ট ২ শতাংশ মানুষ যারা প্রত্যন্ত চরাঞ্চাল এবং দ্বীপগুলোতে বাস করেন তাদেরও দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিদ্যুতের আওতায় আনার কাজ চলমান রয়েছে। প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বলেন, ইতোমধ্যে সাগরের তলদেশ দিয়ে সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ নিয়ে সন্দীপ উপজেলাকে জাতীয় গ্রিডের আওতায় আনা হয়েছে। রাজশাহীর প্রত্যন্ত চরাঞ্চলে বিনামূল্যে সোলার হোম সিস্টেম স্থাপনের মাধ্যমে চরাঞ্চালের বাসিন্দাদের বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত করা হয়েছে। অবশিষ্ট দ্বীপ এবং চরগুলোতেও কিছুদিনের মধ্যেই বিদ্যুতের আওতায় আনা হবে। আশা করছি মুজিববর্ষের মধ্যেই বাংলাদেশ শতভাগ বিদ্যুতের আওতায় আসবে।
উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণ- তিন দিকে বঙ্গোপসাগর আর পূর্বে কুতুবদিয়া চ্যানেল। মাঝখানে প্রায় ২১৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে সাগরের বুকে ভেসে আছে কুতুবদিয়া দ্বীপ। দেশের মূল ভূখ- থেকে বিচ্ছিন্ন কক্সবাজারের এই দ্বীপটিকেও চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের মতো জাতীয় গ্রিডের অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সাবমেরিন ক্যাবল স্থাপন করা হচ্ছে। কক্সবাজারের মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সাগরের তলদেশ দিয়ে বিদ্যুৎ যাবে কুতুবদিয়ায়, বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আসবে দুই লাখ বাসিন্দা। হাতিয়া দ্বীপ, নিঝুম দ্বীপ ও কুতুবদিয়া দ্বীপ শতভাগ নির্ভরযোগ্য ও টেকসই বিদ্যুতায়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় এমন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। অন্যদিকে বেসরকারিভাবে ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্ল্যান্ট (আইপিপি) নির্মাণ করা হবে হাতিয়া দ্বীপে। এর পরে হাতিয়া থেকে নিঝুম দিয়ে ক্যাবলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ নিয়ে যাওয়া হবে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সূত্র জানায়, আইপিপিপির মাধ্যমে হাতিয়া দ্বীপে ৮ থেকে ১০ মেগাওয়াট তরল জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে হাতিয়া দ্বীপে শতভাগ বিদ্যুতায়ন করা হবে। সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে হাতিয়া থেকে চ্যানেলের তলদেশ দিয়ে পারাপার করে নিঝুম দ্বীপ এবং মগনামা হতে চ্যানেলের তলদেশ দিয়ে পারাপার করে কুতুবদিয়া দ্বীপে শতভাগ বিদ্যুতায়ন করা হবে। বর্তমানে পিডিবি গ্রাহক সংখ্যা হাতিয়া দ্বীপে ২ হাজার ৫৫৮ জন, কুতুবদিয়া দ্বীপে ১ হাজার ২০০ জন। নিঝুম দ্বীপে কোন গ্রাহক নেই। প্রস্তাবিত প্রকল্পের মাধ্যমে ৩৭ এমভিএ বা ৩০ মেগাওয়াট ক্ষমতা বৃদ্ধি হবে। এসবের মাধ্যমে ৪২ হাজার গ্রাহককে বিদ্যুৎ সুবিধা দেয়া যাবে।
সমুদ্রতীরবর্তী দুর্গম চরাঞ্চল নিয়ে গঠিত পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলা। সন্ধ্যা নামলেই হারিকেন বা কুপির আলোতে চলে এ এলাকার মানুষের জীবন। সাবমেরিন ক্যাবল ও সৌর প্যানেলের মাধ্যমে এখানকার দুই লাখ ৪০ হাজার পরিবারকে আলোকিত করতে যাচ্ছে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)। প্রতিষ্ঠানটি ইতোমধ্যে তার আওতাধীন ৯৯ শতাংশ এলাকা বিদ্যুতের আওতায় এনেছে। আরইবির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মঈন উদ্দিন (অব.) সংবাদকে বলেন, দেশে মোট ৪৬২টি উপজেলার মধ্যে ৪৬১টিতে শতভাগ বিদ্যুতায়ন সম্পন্ন হয়েছে। রাঙ্গাবালী উপজেলাসহ দেশের হাজারখানেক দুর্গম গ্রাম বাকি রয়েছে। তিন ধাপে এই অফগ্রিড এলাকায় এক হাজার ৫৯টি গ্রামে বিদ্যুতায়ন করা হবে। জামালপুর, ভোলা, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধাসহ বেশকিছু জেলায় পড়েছে এসব দুর্গম গ্রাম। এসব গ্রামে বিদ্যুৎ নিতে বিভিন্ন এলাকার প্রায় ৮৫টি নদী অতিক্রম করতে হবে। তিনি বলেন, প্রথম ধাপে ৬৪৬টি গ্রামে বিদ্যুৎ দেয়া হবে। এজন্য ৩৫টি স্থানে নদীর তলদেশ দিয়ে প্রায় দুই কিলোমিটার পর্যন্ত সাবমেরিন ক্যাবল নিতে হবে। এরপর ওই গ্রামগুলোতে গ্রিড লাইনে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে। এসব গ্রামের এক লাখ ৫৫ হাজার গ্রাহককে চলতি মাসের মধ্যেই গ্রিড লাইনে বিদ্যুৎ দেয়া হবে। দ্বিতীয় ধাপের ৩৮৪টি গ্রাম দুর্গম ও প্রত্যন্ত এলাকায় অবস্থিত। ৫০টি স্থানে সাবমেরিন ক্যাবল দিয়ে নদী অতিক্রম করে গ্রামগুলোতে বিদ্যুতায়ন করা হবে। এসব গ্রামের ৯০ হাজার গ্রাহককে নভেম্বরে গ্রিড বিদ্যুতের আওতায় আনা হবে।
আরইবি চেয়ারম্যান বলেন, অবশিষ্ট ২৯ গ্রাম বেশি দুর্গম এলাকায় অবস্থিত। অধিকাংশ গ্রামেই স্থায়ী জনবসতি নেই। কেবল শুস্ক মৌসুমে বিক্ষিপ্তভাবে মানুষ বসবাস করায় গ্রাহক ঘনত্ব অত্যন্ত কম। এই ২৯ গ্রামের প্রায় ছয় হাজার গ্রাহকের জন্য সোলার হোম সিস্টেম স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এজন্য ৩২৬ কোটি টাকার নিজস্ব অর্থায়নের একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে এই কার্যক্রম শেষ হবে।
পার্বত্য তিন জেলার দুর্গম পাহাড়ে বিদ্যুৎ পৌঁছানোর দায়িত্ব পালন করছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। পিডিবি’র চেয়ারম্যান প্রকৌশলী বেলায়েত হোসেন বলেন, যেখানে গ্রিড লাইন নেয়া যাবে না সেখানে সৌরবিদ্যুৎ দেয়া হবে। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ৫৬ হাজার গ্রাহকের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছানোর জন্য কাজ করছেন। ইতোমধ্যে ৮০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। এর বাইরে আরও ৪০ হাজার পরিবার রয়েছে যাদের এত দুর্গম পাহাড়ে বসতি যে গ্রিড লাইন নেয়া সম্ভব নয়। সেখানে সৌরবিদ্যুৎ সংযোগ দেয়ার কার্যক্রম চলমান।
রংপুর ও রাজশাহীর গ্রিড সুবিধাবঞ্চিত দুর্গম চরে বিনামূল্যে সোলার হোম সিস্টেম স্থাপন করছে নেসকো। এতে ১৩টি চরে বসবাসরত ১২ হাজার ৬৯০টি পরিবার সৌরবিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আসবে। নেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী জাকিউল ইসলাম সংবাদকে বলেন, পদ্মা ও তিস্তার কিছু দুর্গম চরে গ্রিড সুবিধা পৌঁছানো দুষ্কর। তাই এসব চর এলাকা সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে আলোকিত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। প্রথমে রাজশাহীর চারটি চর, আসাড়িয়াদহ, আলাতুলী, মাজারদিয়া, খিদিরপুরের ছয় হাজার ২৪০টি পরিবারকে সৌরবিদ্যুতের আওতায় আনা হচ্ছে। ইতোমধ্যে এই চারটি চরে এক হাজার ৫৭২টি বাড়িতে সোলার হোম সিস্টেম বসানো হয়েছে। এই প্রকল্পে নেসকোর ব্যয় হচ্ছে প্রায় ১৪ কোটি টাকা। রংপুরের ৯টি চরে ছয় হাজার ৪৫০টি পরিবারের মধ্যে সোলার হোম সিস্টেম স্থাপনের কাজ শীঘ্রই শুরু হবে। ডিসেম্বরের মধ্যে এ কার্যক্রম শেষ হবে বলে তিনি জানান। গ্রিড সুবিধাবঞ্চিত দক্ষিণের চর মনপুরায় নয় হাজার এবং পটুয়াখালীর কলাতলী আট হাজার গ্রাহককে সৌর প্যানেলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আনা হবে বলে জানান ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (ওজোপাডিকো) ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী শফিক উদ্দিন।
দেশে বিদ্যুৎ বিতরণে নিয়োজিত ৬টি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি গ্রাহক পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি)। তাদের গ্রাহকসংখ্যা তিন কোটি দুই লাখ। বাকি পাঁচ বিতরণ কোম্পানির অধীনে রয়েছে ৮২ লাখ গ্রাহক। এর মধ্যে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) বিভিন্ন অঞ্চলে গ্রাহক রয়েছে প্রায় ৩৩ লাখ। ঢাকায় বিদ্যুৎ বিতরণকারী ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) গ্রাহক ১২ লাখ ৪৫ হাজার, ঢাকা ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানির (ডেসকো) ১০ লাখ গ্রাহক। উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্বে থাকা নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানির (নেসকো) গ্রাহক ১৪ লাখ। ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো) দক্ষিণের ২১ জেলার ১৩ লাখ গ্রাহকের ঘরে বিদ্যুৎ দিচ্ছে।
প্রায় এক যুগ আগে সবার ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার কাজ শুরু করেছিল। আগামী ছয় মাসের মধ্যে কিছু দুর্গম চর ও পাহাড়ি অঞ্চলের ঘর-বাড়িতেও বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছানোর কার্যক্রম সম্পন্ন করার মাধ্যমে সরকারের লক্ষ্য পূরণ হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে জ্বালানি বিশ্লেষকদের মতে, শতভাগ বিদ্যুতের সঙ্গে মানসপন্ন এবং নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করাও জরুরি। একই সঙ্গে বিদ্যুতের মূল্যও গ্রাহকের সামর্থ্যের মধ্যে রাখতে হবে। তাহলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।