Forum for Energy Reporters Bangladesh
Image default
Bangla News

গ্যাস কম দিয়ে বেশি বিল আদায়

ক্ষতিগ্রস্ত ৪০ লাখ আবাসিক গ্রাহক

কোম্পানিগুলোর বাড়তি আয় বছরে ১৪৪০ কোটি টাকা লাখো অবৈধ সংযোগে চুরি যাওয়া গ্যাসের হিসাবে ভারসাম্য প্রিপেইডে খরচ কম হলেও কোম্পানিগুলোর অনীহা

যতটুকু ব্যবহার ততটুকু বিল’- এটা গ্রাহকের ন্যায্য অধিকার হলেও দেশে আবাসিক খাতে পাইপ লাইনের প্রায় ৪০ লাখ গ্রাহক মাসে যে পরিমাণ গ্যাস ব্যবহার করছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি বিল তাদের দিতে হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বলছে, প্রতিমাসে একজন গ্রাহক গড়ে প্রায় ৩শ’ টাকা বেশি বিল দিচ্ছেন অর্থাৎ মাসে একশ’ বিশ কোটি, বছরে এক হাজার ৪শ’ ৪৪ কোটি টাকা বেশি বিল আদায় করা হচ্ছে। অতিরিক্ত এই টাকা জমা হচ্ছে তিতাস গ্যাস কোম্পানিসহ গ্যাস বিতরণে নিয়োজিত ৬টি কোম্পানির কোষাগারে।

রাষ্ট্রীয় তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশন পেট্রোবাংলার অধীনস্থ ৬টি গ্যাস বিতরণ কোম্পানির মোট প্রায় ৪৩ লাখ ১২ হাজার গ্রাহকের মধ্যে আবাসিক গ্রাহক প্রায় ৪২ লাখ ৮৬ হাজার। এরমধ্যে মিটারবিহীন বা পাইপ লাইনের গ্যাস ব্যবহার করছেন প্রায় ৪০ লাখ গ্রাহক।

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলছে, গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো পাইপ লাইনের গ্রাহকদের কাছ থেকে কড়ায়-গন্ডায় হিসাব করেই মাসিক বিল ধার্য করে। এক্ষেত্রে একটি বার্নার থেকে প্রতিঘণ্টায় সর্বোচ্চ যে পরিমাণ গ্যাস বের হওয়া সম্ভব, তার পুরোটা ধরে একমুখী চুলায় দৈনিক ১০ ঘণ্টা এবং দ্বিমুখী চুলায় দৈনিক ৮ ঘণ্টা জ্বলার হিসেবে ২৬ দিনে যে পরিমাণ গ্যাস খরচ হবে, তার সঙ্গে ‘ডাইভারসিটি ফ্যাক্টর’ গুণ করে সঞ্চালন ও বিতরণ মাশুল এবং মূল্য সংযোজন কর, ভ্যাটসহ এ মূল্য নির্ধারণ করা হয়। যদি কেউ দৈনিক ১০ ঘণ্টার স্থানে ৫ ঘণ্টা চুলা জ্বালায় তার গ্যাস খরচ স্বাভাবিকভাবেই অর্ধেক কমে যায়।

সর্বশেষ গত বছরের ১ জুলাই থেকে কার্যকর হওয়া মূল্যহার অনুযায়ী আবাসিক খাতে একমুখী চুলায় প্রতিমাসে বিল ৯২৫ টাকা এবং দ্বিমুখী চুলায় ৯৭৫ টাকা। প্রিপেইড মিটারের ক্ষেত্রে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ১২ টাকা ৬০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। সে হিসেবে পাইপ লাইনের দ্বিমুখী চুলার একজন গ্রাহক মাসে ৭৭ দশমিক ৩৮ ঘনমিটার গ্যাসের বিল দিচ্ছেন। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, তিন-চার জন সদস্যের ছোট একটি পরিবারে প্রিপেইড মিটার মাসে ৩৫ থেকে ৪০ ঘনমিটার গ্যাস ব্যবহার হয়, খরচ হয় ৪শ’ থেকে ৫শ’ টাকা। ওই পরিবারটি যখন বাসা বদলের কারণে পাইপ লাইনের গ্যাস ব্যবহার করেন তখন তার মাসে ৯৭৫ টাকাই বিল দিতে হয়। একই ঘটনা পাইপ লাইন এলাকা থেকে বাসা বদল করে প্রিপেইড জোনে যাওয়া পরিবারের ক্ষেত্রেও ঘটেছে। এক্ষেত্রে তাদের খরচ মাসে প্রায় ৩শ’ টাকা কমে গেছে।

পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, গ্যাস বিতরণে নিয়োজিত সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (টিজিটিডিসিএল) মোট ২৮ লাখ ৬৫ হাজার ৯০৭ জন গ্রাহকের মধ্যে আবাসিক গ্রাহক ২৮ লাখ ৪৬ হাজার ৪১৯ জন। বাখরাবাদ গ্যাস সিস্টেমস লিমিটেডের (বিজিএসএল) এর মোট গ্রাহক সংখ্যা ৪ লাখ ৯১ হাজার ২১২ জন। এরমধ্যে আবাসিক খাতের গ্রাহক ৪ লাখ ৮৮ হাজার ৭১৩ জন। জালালাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিসন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম লিমিটেড (জেজিটিডিএসএল)-এর মোট গ্রাহক ২ লাখ ২৩ হাজার ৬৬২ জন। আবাসিক গ্রাহক ২ লাখ ২১ হাজার ৯০৬ জন।

পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের (পিজিসিএল ) ১ লাখ ২৯ হাজার ৩৬৭ জন গ্রাহকের মধ্যে আবাসিক গ্রাহক সংখ্যা ১ লাখ ২৮ হাজার ৮৩৭ জন। কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (কেজিডিসিএল)-এর মোট গ্রাহক সংখ্যা ৬ লাখ ২ হাজার ২৪৫ জন। এরমধ্যে আবাসিক খাতের গ্রাহক সংখ্যা ৫ লাখ ৯৭ হাজার ৯৮৫ জন। সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (এসজিসিএল)-এর মোট গ্রাহক ২ হাজার ২৯৯ জন। এরমধ্যে আবাসিক খাতের গ্রাহক ২ হাজার ২৮৬ জন।

২০১৮ সালে বিইআরসি গ্যাসের দাম বৃদ্ধির আদেশে প্রিপেইড মিটার স্থাপনের আদেশ জারি করে। কোম্পানিগুলোর ঢিলেমির কারণে গ্রাহকরা যাতে নিজেরা মার্কেট থেকে মিটার কিনে স্থাপন করতে পারে সেই সুবিধা উন্মুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়। সে অনুযায়ী দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর একটি নীতিমাল প্রণয়ন করা হয়। গত জুলাই মাসে আবাসিক পর্যায়ে খোলাবাজার হতে পিপেইড/স্মার্ট গ্যাস মিটার ক্রয় ও স্থাপন নীতিমালা-২০১৯ প্রসঙ্গে বিইআরসি সচিব রফিকুল ইসলাম স্বাক্ষরিত একটি চিঠি পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যানকে দেয়া হয়। ওই চিঠিতে জানানো হয়, মিটারবিহীন গৃহস্থালি গ্রাহকদের জন্য প্রিপেইড গ্যাস স্থাপন কার্যক্রম সম্পন্ন করলে প্রতি চুলায় ৩৩ ঘনমিটার অর্থাৎ বছরে প্রায় ৫৩ বিসিএফ (বিলিয়ন কিউবিক ফিট) গ্যাস সাশ্রয় হবে। এর বর্তমান বাজারমূল্য আনুমানিক ১ হাজার ৯০০ কোটি টাকা।

জ্বালানি খাতের বিশ্লেষকদের মতে, আবাসিক খাতে পাইপলাইনে গ্যাস ব্যবহারকারীরা গড়ে যে পরিমাণ গ্যাস ব্যবহার করেন, তার বাণিজ্যিক মূল্য প্রদেয় বিলের চেয়ে কম। মাসিক বিল নিয়ে বিতরণ কোম্পানিগুলো লাভবান হচ্ছে, ঠকছেন গ্রাহক। সবাইকে প্রিপেইড মিটার দেয়া হলে বেশিরভাগ গ্রাহকের আর্থিক সাশ্রয় হবে। বিশ্লেষকরা বলছেন, সারাদেশে এখনও ৫ লাখের বেশি অবৈধ সংযোগ চলছে (সূত্র : গণমাধ্যম)। কিন্তু বিতরণ কোম্পানিগুলোর কোন সিস্টেমলস নেই। এটা কিভাবে সম্ভব? সবচেয়ে বড় বিতরণ কোম্পানি তিতাস গ্যাস একবার সিস্টেম গেইনও (অর্থাৎ গ্যাস যা কিনেছে তার চেয়ে বেশি বিক্রি করেছে) করেছে। বিশ্লেষকদের মতে, প্রতিদিন যে পরিমাণ গ্যাস চুরি যাচ্ছে, তা সমন্বয় করতে কৌশলী অবস্থান নিয়েছে কোম্পানিগুলো।

বিইআরসির সদস্য (গ্যাস) মো. মকবুল-ই-ইলাহী চৌধুরী সংবাদকে বলেন, সরকার সব গ্রাহককে প্রিপেইড মিটারের আওতায় আনতে নির্দেশনা দিয়েছে এবং এ সংক্রান্ত নীতিমালাও প্রণয়ন করেছে। কিন্তু এগুলো বাস্তবায়নের দায়িত্ব বিতরণ কোম্পানিগুলোর। তারা সেটি করতে গড়িমসি করছে, অযথা দেরি করছে। আমরা নিয়মিত বিরতিতে কোম্পানিগুলোকে এ বিষয়ে তাগিদ দিয়ে যাচ্ছি।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আনিছুর রহমান সংবাদকে বলেন, দ্রুত দেশের সব আবাসিক গ্যাস সংযোগ প্রিপেইড মিটারের আওতায় আনতে আমরা নিজস্ব উদ্যোগ ও অর্থায়নে অনেক বড় প্রকল্প হাতে নিয়েছি। ইতোমধ্যে সেটা প্রধানমন্ত্রীর সম্মতির জন্য পাঠানো হয়েছে। আগামী আড়াই বছরের মধ্যে এ কাজ শেষ করার জন্য এই প্রকল্পকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, কয়েকটি বিতরণ কোম্পানি সীমিত আকারে প্রিপেইড মিটার স্থাপনের কাজ শুরু করতে চেয়েছিল। তবে সবাইকে সাধ্যমতো সর্বোচ্চ সংখ্যক প্রিপেইড মিটার দ্রুত স্থাপনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

গ্যাস সংকটের কথা বলে ২০০৯ সালে শিল্প ও বাণিজ্যিক খাতে এবং ২০১০ সালে আবাসিকে (বাসায় রান্নায়) নতুন সংযোগ বন্ধ করে দেয় সরকার। দশম সংসদ নির্বাচনের কিছুদিন আগে ২০১৩ সালের মে মাসে আবাসিক খাতে নতুন সংযোগ দেয়া চালু হয়। ওই সময় সিটি নির্বাচন সামনে রেখে রাজশাহীতেও বেশ কিছু আবাসিক সংযোগ দেয়া হয়। তবে ভোটের পর তা বন্ধ হয়ে যায়। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৮ সালের এপ্রিলে আবাসিকে প্রিপেইড মিটারের মাধ্যমে গ্যাস সংযোগ চালু করার ইঙ্গিত দেয়া হয়। কিছু লোক সেই সুযোগ কাজে লাগালেও বঞ্চিত হন অধিকাংশ সংযোগ প্রত্যাশী। নয় বছরের বেশি সময় গ্যাস সংযোগ বন্ধ থাকায় রাজধানীসহ আশপাশের জেলাগুলোতে অবৈধ গ্যাস সংযোগ নেয়ার মহোৎসব চলে। নতুন বাড়ি করে বৈধ সংযোগের জন্য অপেক্ষমাণ অসংখ্য বাড়িওয়ালা ও ফ্ল্যাট মালিকদের হতাশা বাড়তে থাকে। জ্বালানি বিশ্লেষকদের মতে, আবাসিক খাতের সব গ্যাস সংযোগ প্রিপেইড মিটারের আওতায় আনতে হবে। ফলে বিতরণ কোম্পানিগুলোর সব ফাঁক-ফোকর বন্ধ হবে। এতে যে পরিমাণ গ্যাস সাশ্রয় হবে তাতে বাসাবাড়িতে নুতন সংযোগ চালু করায় ক্ষেত্রে কোন সংকট থাকবে না।

Related Posts

‘জ্বালানি মিশ্রণে নবায়নযোগ্য জ্বালানির অংশ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে’

FERB

গ্যাস সংকটে শিল্পে অশনিসংকেত

FERB

দেনা-লোকসানে পিডিবি, তবু নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র

FERB