গ্যাজপ্রমকে তিনগুণ দরে কূপ খনন করতে দেওয়া হলেও মান নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারছে না সংশ্লিষ্টরা। প্রায় ক্ষেত্রেই ২৫ থেকে ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে ওয়ার্কওভার করতে হচ্ছে।
তিতাস#২০ কূপে ১৩৬ কোটি টাকা ব্যয়ে রিমিডিয়াল ওয়ার্ক করতে হয়েছে। শতকোটি টাকা গচ্চা গেলেও বিশেষ একটি মহলের যোগসাজসে চলছে রাষ্ট্রীয় অর্থ লোকসানের মচ্ছব। কোয়ালিটি কাজ না হওয়ায় কোম্পানিটি কালো তালিকাভুক্ত হওয়ার কথা। সেখানে গ্যাজপ্রমকে কাজ দিতে ক্ষেত্র বিশেষে কারো কারো মধ্যে দ্বিগুণ উৎসাহ লক্ষ্যণীয়।
অনেক সমালোচনার মধ্যেই এই কোম্পানিকে ২০১২ সালের ২৬ এপ্রিলে প্রথম ১০টি কূপ খননের কাজ দেওয়া হয়। এগুলো হচ্ছে- বাপেক্সের সেমুতাং ফিল্ডে ১টি, বেগমগঞ্জে ১টি, সুন্দলপুর/শ্রীকাইল ফিল্ডে ১টি ও শাহবাজপুর ফিল্ডে ২টি, বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেডের (বিজিএফসিএল) ৪টি ও সিলেট গ্যাস ফিল্ড লিমিটেডের (এসজিএফএল) রশিদপুর গ্যাস ফিল্ডে ১টি।
বাপেক্সের প্রতিটি কূপের জন্য তারা গড়ে খনন ব্যয় ধরে ১৯.০২ মিলিয়ন ডলার। বিজিএফসিএল ও এসজিএফএল’র ৫টি কূপের খননে গড় ব্যয় ধরা হয় ২০.৪৭ ডলার। এরপর দফায় দফায় আরও ৭টি কূপ খননের কাজ দেওয়া হয় গ্যাজপ্রমকে। যে কাজগুলো মাত্র এক-তৃতীয়াংশ খরচে (৩০ থেকে ৪৫ কোটি) রাষ্ট্রীয় কোম্পানি বাপেক্স সম্পন্ন করার রেকর্ড রয়েছে।
অবাক করার হচ্ছে রাশান বলে যাকে কাজ দেওয়া হয়েছে সেই কোম্পানি নাকি রাশিয়ান গ্যাজপ্রম নয়। যে কোম্পানি কাজ করছে এটি হচ্ছে গ্যাজপ্রম নেদারল্যান্ড। তারাও কিন্তু নিজেরা কাজ করছে না। উজবেকিস্তানের এরিয়াল গ্রুপকে দিয়ে কাজ করাচ্ছে। তারা আবার উপ-ঠিকাদার নিয়োগ দিচ্ছে হেলিবার্টনকে। কিন্তু কাজের কোয়ালিটি নিয়ে প্রশ্ন উঠছে বারবার। তবুও সংশ্লিষ্টরা চোখ বুঝে বসে আছেন।
গ্যাজপ্রম তিতাস#২০ কূপটি খনন শেষ করে ২০১৩ সালের ১৯ মে। নিম্নমানের খনন ও আনুসাঙ্গিক কার্যক্রম কারণে স্বল্প সময়ের মধ্যেই উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায় বলে বাপেক্সের এক রিপোর্টে দেখা গেছে। কূপটি খননকালে ২৩৯৮ মিটারে পাইপ ড্রিল পাইপে আটকে যায়। ১৯ দিন প্রচেষ্টার পর ২১৪৬ মিটার গভীরতায় আংশিক পুনরুদ্ধার হয়। ১৯৬৬ মিটার থেকে সাইডট্রাক করে ৮২ দিনে কাজ শেষ করে। কূপটিতে পরীক্ষামূলক উৎপাদনকালেই অতিরিক্ত পানি আসায় উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। পরে রির্জাভারের সম্ভাব্য ড্যামেজ এড়ানোর জন্য রিমিডিয়াল ওয়ার্ক করা হয়। এ জন্য গ্যাজপ্রম বাড়তি ১৩৬ কোটি ৬৩ লাখ টাকা বিল আদায় করে।
গ্যাজপ্রমের খনন করা আরেকটি কূপ তিতাস#২১ কূপ ২০১৩ সালের ৩০ ডিসেম্বরে উৎপাদন শুরু করে। মাত্র ৬ মাসের মধ্যেই গ্যাসের সঙ্গে অতিমাত্রায় পানি ও বালি (৩৫ এমএমএসসিএফ) এলে (২০১৪ সালের ২০ জুন) উৎপাদন বন্ধ (সেলফ কিলড) হয়ে যায়। সাধারণত টিউবিং এবং সিমেন্টিং যথাযথ না হলে এমন সমস্যা হয়ে থাকে বলে খনি বিশেষজ্ঞদের অভিমত। পরে উত্তোলন সচল করতে বাপেক্সের মাধ্যমে ওয়ার্কওভার করতে গিয়ে টিউবিং প্লেসমেন্টে ত্রুটি ধরা পড়ে।
সেমুতাং#৩ নম্বর কূপের অবস্থাও অভিন্ন। ২০১৪ সালের ৩০ মার্চে খনন কাজ শেষ হয়। ১২ এপ্রিল উৎপাদনে গেলে আট মাসও নিরবিচ্ছিন্ন উৎপাদন করতে পারেনি। নিম্নমানের কাজের কারণে গ্যাসের সঙ্গে অতিমাত্রায় বালি ও পানি আসতে থাকে। বাধ্য হয়ে ২০১৫ সালের ৩ ডিসেম্বর উৎপাদন বন্ধ করা হয়। সিবিএল (সিমেন্ট বন্ডিং লক) পরীক্ষণের ফলাফলে কূপের খুব খারাপ কোয়ালিটি সিমেন্টিং ধরা পড়ে। এই কূপটির জন্য ১৮২ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে গ্যাজপ্রমকে।
শাহবাজপুর#৪ কূপটি খননের জন্য গ্যাজপ্রম ২০২ কোটি ২৪ লাখ টাকা বিল আদায় করে। ২০১৫ সালের ২৩ মে উৎপাদনে গেলেও ৮ মাসের কম সময়ের মধ্যে অতিমাত্রায় বালি ও পানি আসতে থাকে। বাধ্য হয়ে ২০১৬ সালের ২৮ জানুয়ারি উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। পরে লগ বিশ্লেষণ করে দেখা যায় গ্যাসস্তরের নিচে একটি পানির স্তর বিদ্যমান। কূপ খননের সময় যথাযথভাবে সিমেন্টিং না করায় বিপত্তি দেখা দেয়। যার পুরোপুরি গ্যাজপ্রমের অবহেলার কারণে ঘটেছে। কূপটিতে হঠাৎ গ্যাস উত্তোলন বন্ধ হলে ভোলা ২২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ হয়। পরে কূপটির ওয়ার্কওভার করতে হয়।
বেগমগঞ্জে#৩, শাহবাজপুর#৩, শ্রীকাইল#৪ পানি চলে আসায় ওয়ার্কভার করতে হয়। অন্যান্য কূপেও যাচ্ছে তাই কাজ করার তথ্য উঠে এসেছে বাপেক্সের তদন্তে। প্রায় ৮০ ভাগ ক্ষেত্রে সিবিএলে ত্রুটি পেয়েছে বাপেক্স। অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন (২০১৬ সালের ১৭ নভেম্বর) পেট্রোবাংলার কাছে পাঠায়। রিপোর্টে বাপেক্স উল্লেখ করেছে তারা কিভাবে বিনিয়োগ করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তথ্য নির্ভর এই কাজটি করেন তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী আতিকুজ্জামান। এই কাজের জন্য তার পুরস্কার পাওয়ার কথা। কিন্তু মাত্র ৬ দিনের ব্যবধানে তাকে বাপেক্সের এমডি পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। সাহসী ওই কর্মকর্তার এমন অপমানজনক বিদায়ে অন্যরা যা বুঝার বুঝে নিয়েছেন। আর যাই হোক গ্যাজপ্রম ইস্যুতে মুখে কুলুপ এটে বসে আছেন। তারা মনে করেন বললে হয় চাকরী যাবে না হলে বিদায় নিতে হবে। কাজের কাজ কিছুই হবে না।
যাদের কাজের দর আকাশ ছোঁয়া, এতো এতো বদনাম। তাদেরকেই আবারও বিশেষ আইনে ৩টি কূপ দেওয়া হচ্ছে। জনশ্রুতি রয়েছে সম্ভাবনাময় গ্যাস রিজার্ভার ভোলার বিশাল একটি অংশ ইজারা নিতে গোপন তৎপরতায় লিপ্ত গ্যাজপ্রমের এজেন্টরা।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, একটি উন্নয়ন কূপ করার পর দশ-পনের বছর পরে ওয়ার্কওভার করতে হতে পারে। কিন্তু সাত-আট মাসের মধ্যে ওয়ার্কওভার করতে হলে অস্বাভাবিক। এতে কাজের মান নিয়ে প্রশ্ন আসতেই পারে। গ্যাজপ্রমের কাজের পুরো বিষয়টি স্বাভাবিক না।
ছাতক গ্যাস ফিল্ড বাপেক্স আবিষ্কার করে, পরে ফিল্ডটি নাইকোকে দেওয়া হয়। যখন দুর্ঘটনা ঘটল তখন বেরিয়ে আসে অনেক ঘটনা। ভোলা গ্যাস ফিল্ডে কি একই রকম ঘটছে এ প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ক্যাবের জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বার্তা২৪.কমকে বলেন, ভোলার কূপ খননের বিষয়টি বাংলাদেশের জ্বালানি চাহিদার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। নাইকোকে যেমন বিশেষ ব্যক্তিদের লাভ-লস হিসেব করে কাজ দেওয়া হয়েছিল। এখানেও তাই হচ্ছে।
বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলীকে কয়েক দফায় ফোন দিলেও ব্যস্ততার কথা বলে এড়িয়ে গেছেন। চতুর্থ দফায় ফোন রিসিভ করে পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যানের দফতরে আছেন বলে কেটে দেন।