গ্যাস সংকটের কথা বলে সরকার আবাসিক খাতে নতুন সংযোগ দেয়া বন্ধ রাখলেও রাজধানীর আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় দৃশ্যমান অবৈধ গ্যাস সংযোগ লাইন বছরের পর বছর ধরে বহাল আছে। অবৈধ এসব বিতরণ লাইন টানা হয়েছে কোথাও ব্রিজের উপর দিয়ে, কোথাও সড়কের পাশ দিয়ে। রাষ্ট্রীয় ছয়টি গ্যাস বিতরণ কোম্পানির মধ্যে অবৈধ সংযোগ তিতাস গ্যাস কোম্পানির আওতাভুক্ত এলাকায়ই বেশি। তিতাসের আওতাভুক্ত এলাকার আশপাশেও বাড়ি বাড়ি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে শত শত রাইজার। বিতরণ কোম্পানি, স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ সবার চোখের সামনে প্রায় পাঁচ বছর আগে টানা এসব অবৈধ সংযোগের বেশিরভাগই এখনও সচল আছে।
নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্র বলছে, সংশ্লিষ্টদের পৃষ্ঠপোষকতায় এসব অবৈধ সংযোগ নেয়া হয়েছে। উচ্চ পর্যায়ের চাপে কোথাও লাইন কাটা হলেও কিছুদিন পরই আবার অবৈধ সংযোগ নেয়া হচ্ছে বিতরণ কোম্পানি, স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশকে ম্যানেজ করেই। অনেক এলাকায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও সমর্থকদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ তত্ত্বাবধানে চলছে এই গ্যাস চুরির মহাযজ্ঞ। দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্র কোটি কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে। অথচ রাজধানীসহ আশপাশের এলাকায় বৈধ সংযোগের জন্য অপেক্ষমাণ নাগরিকরা বঞ্চিত হচ্ছেন গ্যাস সুবিধা থেকে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আনিছুর রহমান ২২ আগস্ট শনিবার বিকেলে সংবাদকে বলেন, সব অবৈধ লাইন উচ্ছেদ হবে। কোথাও কোন অবৈধ সংযোগ থাকবে না। এ লক্ষ্যে অভিযান চলছে। শনিবারও কয়েক জায়গায় অভিযান হয়েছে। অবৈধ সংযোগ বেশি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ ও বন্দরে। আমরা পুলিশ, স্থানীয় প্রশসানকে নিয়ে সমন্বিত অভিযান পরিচালনা করছি। অনেকক্ষেত্রে রাজনৈতিক বাধা আসে। তবে কোন বাধায় আর কাজ হবে না।
সিনিয়র সচিব মো. আনিছুর রহমান বলেন, এসব অবৈধ লাইন প্রদানের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় বিতরণ কোম্পানিগুলোর যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জড়িত, প্রমাণিত হলে তাদের বিরুদ্ধেও আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি জানান, অবৈধ গ্যাস সংযোগকে বৈধ করতে মূল সার্ভারে তথ্যের অনুপ্রবেশের করানোর কারণে সম্প্রতি এক উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম)-সহ তিতাসের ৫ জনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিশন কোম্পানি লিমিটেডের (তিতাস গ্যাস) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী আলী মো. আল-মামুন শনিবার সন্ধ্যায় সংবাদকে বলেন, আমি গত ডিসেম্বরে দায়িত্ব নিয়েই অভিযান শুরু করেছিলাম। তবে করোনার কারণে তা বাধাগস্ত হয়। এখন আমরা আবার অভিযান শুরু করেছি। সম্প্রতি ঢাকার বনশ্রী, নারায়ণগঞ্জের বন্দরে বড় অভিযান পরিচালনা করে অনেক অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। আমরা নতুন করে তিতাসের ৩৬ জন সদস্যকে ৬টি জোনে ভাগ করে অভিযান পরিচালনার প্রস্তুতি নিয়েছি। আজ থেকেই অভিযান পুরোদমে শুরু হবে। সার্ভারে অবৈধ গ্যাস সংযোগের তথ্য অনুপ্রবেশের কারণে এক ডিজিএমসহ ৫ কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত এবং ৮ জন ঠিকাদারকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে বলেও জানান তিনি। দৃশমান সংযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, সব জায়গার সব তথ্যতো পাওয়া যায় না, তবে সাংবাদিকদের নজরে এলে ওই এলাকার তথ্য যদি আমাকে জানানো হয়, দ্রুত সেখানে অভিযান পরিচালনা করে অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হবে।
সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা গেছে, তিতাস গ্যাস কোম্পানির আওতাধীন এলাকা মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে রাষ্ট্রীয় বিতরণ লাইন কেটে অবৈধভাবে বড় ভাটেরচর, টেংগারচর, উপজেলা পরিষদসহ আশপাশের অনেক গ্রামে অবৈধ গ্যাস সংযোগ দেয়া হয়েছে। এই লাইনটি জামালদী বাসস্ট্যান্ড থেকে বড় ভাটের চর যাওয়ার পথে ১৫০ মিটারের একটি স্টিলের ব্রিজের উপর দিয়ে প্রায় পাঁচ বছর আগে টানা হয়েছে। মাঝখানে একবার এই লাইন কাটা হলেও এখন তা পুরোদমে চলছে।
সম্প্রতি হোসেন্দী এলাকায় থেকে ১৫ কিলোমিটারের আরেকটি অবৈধ গ্যাস লাইন হোসেন্দী, নাজিরচর, ফুলদীসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রামে এমনকি পার্শ্ববর্তী একটি চরেও টান হয়েছে। এসব গ্রামের বাড়ি বাড়ি কোরবানি ঈদের আগে অবৈধ সংযোগ নেয়ার ধুম পড়ে। যারা আগে লাইন টানার জন্য ১০ হাজার করে টাকা দিয়েছিলেন, তারা সম্প্রতি আরও ১৮ হাজার টাকা দিয়ে, যারা আগে কোন টাকা দেননি তারা এককালীন প্রতি দুই চুলার জন্য ২৮ হাজার টাকা করে দিয়ে অবৈধ সংযোগ নিচ্ছেন। স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, সাবেক এক জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় এক মুক্তিযোদ্ধা নেতা এবং সরকারি এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এই অবৈধ সংযোগটির নেয়ার ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। আরেক লাইন গেছে আনারপুরা, মীরেরগাঁও, উত্তর শাহপুরের দিকে। বাউশিয়া এলাকায় অনেকগুলো গ্রামে চলছে অবৈধ সংযোগ।
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলায়ও জালের মতো বিছিয়ে আছে অবৈধ সংযোগ। এরমধ্যে কোন কোন লাইন অভিযানের মাধ্যমে কাটা হয়েছে। সম্প্রতি কাটা যাওয়া আনন্দবাজার, হামছাদী, দামোদরদী, ছনপাড়া, টেকপাড়া, খামারগাঁওয়ের একটি লাইন আবার নিতে স্থানীয় প্রভাবশালীদের একটি চক্র পুনরায় সংযোগ প্রতি তিন থেকে চার হাজার টাকা করে উঠিয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, গাজীপুর এলাকায় অবৈধ সংযোগ বেশি। তিতাসের অন্য এলাকায়ও বৈধ সংযোগের আড়ালে অবৈধ অসংখ্য সংযোগ রয়েছে। নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্র বলছে, অনেক এলাকায় তিতাসের কর্মচারীরা সংযোগ প্রতি মাসিক টাকা নিয়ে এসব সংযোগ বহাল রাখছে।
জ্বালানি খাতের বিশ্লেষকদের মতে, রাষ্ট্রীয় বিতরণ কোম্পানিগুলো চাইলে এসব অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা কঠিন কিছু নয়। এক্ষেত্রে শীর্ষ কর্মকর্তাদের সদিচ্ছাই যথেষ্ট। যেহেতু কোম্পানির বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের একটি চক্রের যোগসাজশে অবৈধ সংযোগের বিস্তার ঘটাছে, তাই দ্রুত তদন্ত করে প্রথমে নিজ কোম্পানির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। পাশাপাশি এসব অবৈধ সংযোগ উচ্ছেদে অভিযান পরিচালনা করতে হবে। অবৈধ সংযোগ বিচ্ছেদের পর ওইস্থানে নজরদারি অব্যাহত রাখতে হবে, যাতে গ্যাস চোর চক্র পুনঃসংযোগ না নিতে পারে। বিশ্লেষকরা বিভিন্ন গণমাধ্যমের সূত্র ধরে বলছেন, সারাদেশে ৫ লাখের বেশি অবৈধ গ্যাস সংযোগ রয়েছে। বছরের পর বছর ধরে এসব সংযোগ চলছে। যা রাষ্ট্রের জন্য বড় ক্ষতি। অথচ সে হিসেবে তিতাসের সিস্টেম লস তেমন নেই। কারণ পাইপ লাইনের গ্যাস ব্যবহারকারী প্রায় ২৫ লাখ গ্রাহক কম গ্যাস ব্যবহার করে বেশি বিল দিচ্ছে। তবে রাষ্ট্রের স্বার্থে দ্রুততম সময়ে সব অবৈধ সংযোগ উচ্ছেদে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ নেয়া উচিত।
সারাদেশে রাষ্ট্রীয় ৬টি কোম্পানি গ্যাস বিতরণে নিয়োজিত। এগুলো হলোÑ তিতাস, কর্ণফুলী, পশ্চিমাঞ্চল, জালালাবাদ, বাখরাবাদ ও সুন্দরবন। সারাদেশে বৈধ গ্যাস সংযোগ রয়েছে প্রায় ৪৩ লাখ। সবচেয়ে বড় বিতরণ কোম্পানি তিতাসের আবাসিক গ্রাহক ২৮ লাখ ৪৬ হাজার (মোট গ্রাহক ২৮ লাখ ৬৫ হাজার)। বাকি ৫টি কোম্পানির মোট সংযোগ প্রায় ১৫ লাখ। গ্যাস সংকটের কথা বলে ২০০৯ সালে শিল্প ও বাণিজ্যিক খাতে এবং ২০১০ সালে আবাসিকে (বাসায় রান্নায়) নতুন সংযোগ বন্ধ করে দেয় সরকার। দশম সংসদ নির্বাচনের কিছুদিন আগে ২০১৩ সালের মে মাসে আবাসিক খাতে নতুন সংযোগ দেয়া চালু হয়। ওই সময় সিটি নির্বাচন সামনে রেখে রাজশাহীতেও বেশ কিছু আবাসিক সংযোগ দেয়া হয়। তবে ভোটের পর তা বন্ধ হয়ে যায়। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৮ সালের এপ্রিলে আবাসিকে প্রিপেইড মিটারের মাধ্যমে গ্যাস সংযোগ চালু করার ইঙ্গিত দেয়া হয়। কিছু লোক সেই সুযোগ কাজে লাগালেও বঞ্চিত হন অধিকাংশ সংযোগ প্রত্যাশী।
নয় বছরের বেশি সময় গ্যাস সংযোগ বন্ধ থাকায় রাজধানীসহ আশপাশের জেলাগুলোতে অবৈধ গ্যাস সংযোগ নেয়ার মহোৎসব চলে, যা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয় তিতাস গ্যাস কোম্পানি। অন্য ৫টি কোম্পানির বিতরণ এলাকায়ও কমবেশি অবৈধ সংযোগ নেয়ার ঘটনা ঘটে। গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো অভিযান চালিয়ে মাঝে-মধ্যে লাইন কাটলেও কয়েক দিনের মধ্যেই অবৈধ সংযোগ আবার চালু হয়ে যায়।