নিয়ম-নীতি উপেক্ষা করে রাজধানীসহ সারাদেশে যত্রতত্র বিক্রি হচ্ছে এলপি গ্যাস সিলিন্ডার। আবাসিক এলাকায় মজুদ করা হচ্ছে এই বিস্ফোরক। আইন অনুযায়ী, তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) মজুদ ও বিপণন করতে হলে বিস্ফোরক পরিদফতরের লাইসেন্স গ্রহণ আবশ্যক। সরেজমিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, খুচরা পর্যায়ে বেশিরভাগ এলপিজি বিক্রেতারই লাইসেন্স নেই। বিক্রয়কেন্দ্রগুলোতে নেই পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রপাতি এবং সরঞ্জাম। এলপিজি পরিবহনের ক্ষেত্রেও অনিয়ম চোখে পড়ছে অহরহ। মুদি দোকান, পান দোকান এমনকি মোবাইল রিচার্জের দোকানেও বিক্রি হচ্ছে এলপিজি সিলিন্ডার। দেশের বিভিন্ন জেলা, উপজেলা থেকে স্থানীয় প্রতিনিধিদের পাঠানোর তথ্যেও এলপিজির খুচরা বিপণনে এসব অনিয়মের তথ্য পাওয়া গেছে।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ সূত্র বলছে, দেশে যে হারে এলপিজির ব্যবহার বাড়ছে, সে হিসেবে ২০৪১ সালে চাহিদা ৮০ লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে। বিস্ফোরক পরিদফতর সূত্র বলছে, এলপি গ্যাস বাতাসের চেয়ে ভারি হওয়ায় উড়ে যায় না। বদ্ধ স্থানে লিকেজ হলে গ্যাস বের হয়ে বোতলের আশপাশেই জমে থাকে। সূত্র বলছে, লিকেজের মাধ্যমে বাতাসের সঙ্গে দুই ভাগ এলপিজির সংমিশ্রণ ঘটার পর তা আগুনের সংস্পর্শে এলে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে।
জ্বালানি বিশ্লেষকদের বলছেন, রান্নায় পাইপলাইনে গ্যাস সংযোগ বন্ধ থাকায় বাসাবাড়ি, হোটেল-রেস্তোরাঁয় এলপি গ্যাসের ব্যবহার বাড়ছে। এছাড়া, যানবাহনেও এলপি গ্যাস ব্যবহার শুরু হয়েছে। ইদানীং নগরীর বহুতল ভবনের নিচ তলায় সব ফ্লাটের এলপিজি সিলিন্ডার একসঙ্গে রেখে পাইপ লাইনের মাধ্যমে চুলায় সংযোগ দেয়া হচ্ছে। আবার ভবনের নিচে বা পাশে কেন্দ্রীয়ভাবে বড় সিলিন্ডার (বুলেট সিলিন্ডার) স্থাপন করে এলপিজি’র ব্যবহার শুরু হয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে দোকানগুলোর ভেতরে মজুদ রাখা হচ্ছে সারিসারি গ্যাস ভর্তি সিলিন্ডার। বিশ্লেষকরা বলেন, জনগণের জানমালের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে এখন থেকেই এই বিস্ফোরক (এলপিজি) উৎপাদন, মজুদ, পরিবহনসহ সব ক্ষেত্রে সরকারকে কঠোর হওয়া প্রয়োজন। অন্যথায় বড় দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটতে পারে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আবাসিক এলাকায় বহুতল ভবনের নিচতলায় মজুদ করে বিক্রি করে হচ্ছে এলপিজি সিলিন্ডার। আবার বাড়ি বাড়ি এলপিজি সিলিন্ডার পৌঁছে দেয়ার কাজে ব্যবার করা হচ্ছে দ্বিচক্র যান (বাই-সাইকেল), যা বেআইনি। দেখা গেছে, বাই-সাইকেলের দু’পাশে বিশেষ কাঠামো তৈরি করে দুটি সিলিন্ডার রাখে এর ওপর শুইয়ে আরেকটি সিলিন্ডার বহন করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, সরকারি ও বেসরকারি উৎপাদক কোম্পানিগুলো সারাদেশে ডিলার, এজেন্টের মাধ্যমে এলপিজি সিলিন্ডার বিপণন করে। ডিলার বা এজেন্টদের কাছ থেকে এসব সিলিন্ডার খুচরা বাজারে পর্যায়ক্রমে পাড়া-মহল্লার দোকানে বিক্রি হয়। এক্ষেত্রে লাইসেন্স ছাড়া ব্যবসায়ীদের কাছে সহজেই এলপিজি সিলিন্ডার পৌঁছে যায়।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর এক খুচরা এলপিজি ব্যবসায়ী সংবাদকে বলেন, এই ব্যবসায় লাইস্যান্স নিতে হয়, শুনেছি। তবে ঝামেলার কারণে নেয়া হয়নি। তিনি বলেন, এজেন্টরা যদি মাল না দিতো, তাহলে সবাই লাইসেন্স করতে বাধ্য হতো। মালিবাগের এক ব্যবসায়ী বলেন, গ্রাহকের কাছ থেকে প্রতি সিলিন্ডারে ভাড়া বাবদ ২০ থেকে ৩০ টাকা পাই। আমার কর্মচারী সাইকেলে করে সিলিন্ডার বাসায় দিয়ে আসে। নিরপত্তার বিষয়ে তিনি বলেন, দু’একটি সিলিন্ডার তো পিকআপে করে দিয়ে আসা সম্ভব নয়।
এলপিজি বিধিমালা, ২০০৪ অনুসারে, এলপিজি সিলিন্ডার কোন দ্বিচক্র যানে পরিবহন করা যাবে না। এছাড়া, এলপিজি সিলিন্ডার বহনকারী যানে কমপক্ষে ৭ কেজি ধারণক্ষমতাসম্পন্ন কার্বন-ডাই-অক্সাইড বা ১১ কেজি ধারণক্ষমতাসম্পন্ন ড্রাই কেমিক্যাল ধরনের অগ্নিনির্বাপক গাড়ি চালকের সহজলভ্য স্থানে থাকতে হবে। তবে এজেন্টদের কাছ থেকে খুচরা ব্যবসায়ীরা এলপিজি সিলিন্ডার নিয়ে যাওয়ার সময় যেসব যান ব্যবহার করে সেখানে অগ্নিনির্বাপনের কোন ব্যবস্থা থাকে না। এসব বিস্ফোরক ব্যবসায়ীদের দোকানে অপ্রাপ্ত বয়স্ক কর্মচারীদেরও (১৮ বছরের নিচে) কাজ করতে দেখা যায়, যা আইনসম্মত নয়।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আনিছুর রহমানের সভাপতিত্বে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এক সমন্বয় সভায় যত্রতত্র এলপিজি সিলিন্ডার বিক্রির বিষয়টি আলোচিত হয়। সভায় সিনিয়র সচিব বলেন, বর্তমানে যত্রতত্র এমনকি মুদি দোকানেও এলপিজি সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসকদের চিঠি দিতে এবং নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনার জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকেও অনুরোধ জানিয়ে চিঠি পাঠাতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন জ্বালানি সচিব। এছাড়া, বিস্ফোরক পরিদফতরের ভিজিল্যান্স বাড়তেও নির্দেশ দেন তিনি।
২০১৬ সালের ২০ আগস্ট বগুড়ার শাজাহানপুরের লিচুতলা এলাকায় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) পদ্মা অয়েল কোম্পানির এলপি গ্যাস ডিপোতে ৩৭৮টি সিলিন্ডার ট্রাক থেকে আনলোড করার সময় একটি সিলিন্ডার মাটিতে পড়ে যায়। সেটির মুখ দিয়ে গ্যাস নির্গত হওয়া শুরু হলে মুহূর্তের মধ্যে পুরো ট্রাকে আগুন ধরে ১৯৩টি সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়। এছাড়া, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রতি বছরই এলপি গ্যাসের বিস্ফোরণে হতাহতের খবর পাওয়া যায়। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলছে, একই সিলিন্ডার দীর্ঘদিন ব্যবহারে পর এটি আর পরীক্ষা না করানোর কারণে অনেক সময় গ্যাস লিক করে দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। তাই যথাসময়ে, সব সিলিন্ডার পরীক্ষা করানোর বিষয়টিও সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে।
জ্বালানি বিভাগের সূত্রে জানা গেছে, দেশে গত ১০ বছরে এলপিজির ব্যবহার ব্যাপক হারে বেড়েছে। বছরে এ বৃদ্ধির হার গড়ে ৩৫ শতাংশ। তবে সবচেয়ে বেশি হারে (৯২ শতাংশ) বেড়েছে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে। চাহিদা অনুযায়ী দেশে বার্ষিক ১৫ লাখ টনের বেশি এলপিজি সরবরাহ দরকার। তবে আমদানি ও বিক্রি হচ্ছে বার্ষিক প্রায় ১০ লাখ টন। এরমধ্যে বিপিসির অধীনস্থ রাষ্ট্রীয় কোম্পানি ‘এলপি গ্যাস লিমিটেড’ সরবরাহ করে চাহিদার মাত্র দুই শতাংশ। অবশিষ্ট ৯৮ শতাংশ এলপি গ্যাস দেশের প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান যমুনা, বসুন্ধরা, ওরিয়ন, ওমেরা, নাভানা নিজ নামে এবং আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ক্লিনহিট, টোটাল, পেট্রোম্যাক্স, লাফার্স, জি-গ্যাস, ডেলটা নামে বাজারজাত করছে। এদিকে আবাসিকখাতে পাইপলাইনে গ্যাস সংযোগ বন্ধ রাখা হলেও এলপিজির বাজারমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না সরকার। বোতলের গায়ে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য লেখার সরকারি নির্দেশও বাস্তবায়ন হচ্ছে না।