দেশে বিপুল পরিমাণ বিদ্যুত্ উদ্বৃত্ত থাকলেও নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় (ক্যাপটিভ পাওয়ার) বিদ্যুত্ উত্পাদন করে শিল্পের চাকা চালু রাখছেন উদ্যোক্তারা। বিদ্যুতের উত্পাদন বৃদ্ধির সমান্তরালে সঞ্চালন ও বিতরণব্যবস্থার উন্নয়ন না করায় এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এর ফলে ত্রিমুখী ক্ষতি হচ্ছে। বিদ্যুতের সার্বিক উত্পাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় প্রায় প্রতি বছর নিত্যপ্রয়োজনীয় এই সেবাপণ্যের দাম বাড়ছে। খরচ বাড়ছে জনগণের। সরকারি কোষাগার থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ভর্তুকি বাবদ বেরিয়ে যাচ্ছে। উত্পাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় বিশ্ববাজারে মূল্য প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা কমছে রপ্তানিমুখী পণ্যগুলোর।
বিদ্যুত্ বিভাগ ও বাংলাদেশ বিদ্যুত্ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সূত্রে জানা যায়, দেশে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে বিদ্যুেকন্দ্র রয়েছে ১৩৮টি। এগুলোর দৈনিক উত্পাদনক্ষমতা ২০ হাজার ৩৮৩ মেগাওয়াট। এখন পর্যন্ত দিনে সর্বোচ্চ ব্যবহূত হয়েছে ১২ হাজার ৮৯৩ মেগাওয়াট বিদ্যুত্। আর গড় ব্যবহার ১১ হাজার মেগাওয়াটের বেশি নয়। ফলে অন্তত সাড়ে ৭ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উদ্বৃত্ত থাকছে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, ১০ শতাংশের বেশি বিদ্যুত্ উদ্বৃত্ত রাখা উচিত নয়। সে হিসেবে দেশে ২ হাজার ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ অলস থাকতে পারে। দৈনন্দিন প্রয়োজনের চেয়ে সাড়ে ৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত্ জাতীয় গ্রিডে উদ্বৃত্ত থাকছে। চলতি বছর আরো ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ গ্রিডে আসবে। অথচ দেশের বড় শিল্প কারখানাগুলো নিজস্ব ব্যবস্থায় বিদ্যুত্ উত্পাদন করে নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। শিল্পের এই নিজস্ব বিদ্যুত্ উত্পাদনকে ক্যাপটিভ পাওয়ার বলা হয়।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) তথ্য অনুযায়ী, ২ হাজার ৯০৭টি কারখানায় প্রায় ৩ হাজার ৭০৭ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদন করার সক্ষমতা রয়েছে। তবে এ ধরনের কারখানার সংখ্যা এবং মোট উত্পাদনক্ষমতা অনুমোদিত সংখ্যা ও সক্ষমতার চেয়ে বেশি বলে জানিয়েছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
শিল্পমালিকেরা বলছেন, সরকারের বিদ্যুত্ বিতরণকারী কোম্পানিগুলো নিরবচ্ছিন্ন ও মানসম্পন্ন বিদ্যুত্ দিতে না পারায় তারা ক্যাপটিভ বিদ্যুতে ঝুঁকেছেন। গ্রিড বিদ্যুতের চেয়ে ক্যাপটিভ বিদ্যুতে খরচ বেশি হলেও এতেই তারা নির্ভর করছেন। কেননা, গ্রিড বিদ্যুতের সরবরাহ এখনো নিরবচ্ছিন্ন পাওয়া যায় না। তার ওপর এর ভোল্টেজ প্রায় সময়ই ওঠানামা করে। এতে উত্পাদন ব্যাহত ও পণ্যের ক্ষতি হয়, যে কারণে বিপুল পরিমাণ লোকসানও গুনতে হয়েছে অনেক ব্যবসায়ীকে। এছাড়া ভোল্টেজ ওঠানামায় কারখানার যন্ত্রপাতির ক্ষতি হয় এবং এদের জীবনকাল কমে যায়। ফলে এককালীন ক্ষতিও কম নয়। উত্পাদনে এই বাধা ও ক্ষতির কারণে পণ্যের দাম বেড়ে যায়, যার প্রভাব খুচরা ভোক্তা পর্যায়েও পড়ে। আর রপ্তানিমুখী শিল্পে খরচ বেড়ে যাওয়ায় বৈশ্বিক বাজারে মূল্য প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশের পণ্য।
শিল্পে রক্তক্ষরণ
সাভার, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, মুন্সীগঞ্জ ও ময়মনসিংহে স্থাপিত কয়েকটি শিল্পকারখানার মালিক ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সঠিক লোড ও ভোল্টেজে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত্ সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য বিদ্যুত্ বিতরণকারী সংস্থাগুলোর সঙ্গে দীর্ঘদিন দেনদরবার করে। কিন্তু ফল না পাওয়ায় দুই দশকের বেশি সময় ধরে বড় শিল্পকারখানাগুলো ক্যাপটিভ বিদ্যুতের ওপর নির্ভর করেই চলছে। ১ থেকে ৫ মেগাওয়াটের এই ছোট ছোট বিদ্যুেকন্দ্রগুলো শিল্প উত্পাদনে জ্বালানির নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করলেও বহুমাত্রিক খরচ বাড়িয়েছে। ফলে উত্পাদিত পণ্যের দাম বাড়ছে। প্রতিযোগিতামূলক বাজারে সক্ষমতা কমছে।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা যায়, এখনো গাজীপুরে স্থাপিত কারখানাগুলোতে বছরে গড়ে ৪৩৮ ঘণ্টা বিদ্যুত্ সরবরাহ থাকে না। সাভার, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামে বার্ষিক এই লোডশেডিংয়ের পরিমাণ যথাক্রমে ৩৩০, ২৯২ ও ৩৩৮ ঘণ্টা। বিদ্যুতের লোড ও ভোল্টেজ ওঠানামার কারণে কারখানাগুলোতে বছরে ৩৫ লাখ থেকে ৫৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ক্ষতি হয়।
এছাড়া বিদ্যুতের নতুন সংযোগ পেতেও ভুগতে হয় উদ্যোক্তাদের। গত মাসে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশে একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের বিদ্যুত্ সংযোগ পেতে গড়ে চার মাস পাঁচ দিন সময় লাগে।
এমন প্রেক্ষাপটে জেনারেটরে উত্পাদিত ক্যাপটিভ বিদ্যুতে ভরসা করতে হয় বিভিন্ন শিল্পের মালিকদের। ক্যাপটিভ বিদ্যুতের জেনারেটর, ব্যাকআপ ব্যাটারি, জ্বালানি (গ্যাস বা ডিজেল), আলাদা জনশক্তি ও স্থাপনা বাবদ বিপুল অর্থ খরচ হয় শিল্প মালিকদের। এদের মধ্যে অনেকের কারখানার নিজস্ব চাহিদা মিটিয়েও আরো বিদ্যুত্ উত্পাদন করার ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু দাম নিয়ে সরকারের সঙ্গে একমত না হওয়ায় সেই অব্যবহূত বিদ্যুত্ও গ্রিডে আসছে না। শিল্প উদ্যোক্তারা বলছেন, ক্যাপটিভ পাওয়ারের অব্যবহূত বিদ্যুত্ ব্যবহার করা গেলে উত্পাদন খরচ কমানো যেত। যার ইতিবাচক প্রভাব পড়ত দেশীয় এবং রপ্তানিনির্ভর পণ্যেও।
নরসিংদীর একটি পোশাক তৈরির কারখানার মালিক জানান, তার কারখানায় ক্যাপটিভ বিদ্যুতের জেনারেটর স্থাপনসহ এককালীন খরচ হয় প্রায় ১১ কোটি টাকা। এখন প্রতিমাসে জ্বালানি এবং এই খাতে কর্মরতদের বেতনভাতা বাবদ ৫০ লাখ টাকা খরচ হয়। এটি একেবারেই অতিরিক্ত খরচ। কিন্তু নিরুপায় হয়ে তা করতে হচ্ছে।
এনার্জিপ্যাক ফ্যাশনস এবং এনার্জিপ্যাক পাওয়ার জেনারেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়ুন রশিদ বলেন, বিদ্যুত্ উত্পাদনে সাফল্য থাকলেও সঞ্চালন ও বিতরণে এখনো দুর্বলতা-ত্রুটি রয়ে গেছে। মানসম্পন্ন নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত্ সরকার এখনো নিশ্চিত করতে পারেনি। সেটি করতে পারলে ক্যাপটিভ ব্যবহার কমবে। শিল্পে গ্রিড বিদ্যুতের ব্যবহারও বাড়বে।
বিদ্যুত্ ও জ্বালানি খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিইআরসির সদস্য (গ্যাস) মো. মকবুল-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, বেশি খরচ হলেও শিল্পমালিকরা ক্যাপটিভ বিদ্যুত্ ব্যবহার করছেন নিরবচ্ছিন্ন ও গোলযোগহীন বিদ্যুত্ না পাওয়ার কারণে। সরকার টেকসই বিদ্যুত্ নিশ্চিত করতে কাজ করছে। সেভাবে নানানীতি এবং পরিকল্পনাও করা হয়েছে। এখন বিতরণ ও সঞ্চালন সংস্থাগুলোকে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। বিইআরসি নিয়মিত সে নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে।
সম্প্রতি এক সেমিনারে বিদ্যুত্, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, বিদ্যুত্ উত্পাদন নিয়ে এখন কোনো সমস্যা নেই। পর্যাপ্ত বিদ্যুত্ রয়েছে। কিন্তু মানসম্পন্ন ও টেকসই বিদ্যুত্ উত্পাদন ও সরবরাহ বড় চ্যালেঞ্জ। শিল্প এবং বাণিজ্যে বিদ্যুত্ ব্যবহার বৃদ্ধির জন্য ইতিমধ্যে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে বিদ্যুত্ বিভাগ। তাদের সমস্যা এবং দাবিগুলো নিয়ে ইতিমধ্যে কাজ শুরু হয়েছে।
বিপুল ভর্তুকিতে চাপ বাড়ছে কোষাগারে
দেশে চাহিদা না থাকায় অনেক বেসরকারি বিদ্যুেকন্দ্র অলস পড়ে থাকে। উত্পাদন না হলেও এগুলোর স্থাপনা বা কেন্দ্রভাড়া বাবদ মাশুল (ক্যাপাসিটি চার্জ) দিতে হয় সরকারকে। সর্বশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে বেসরকারি কেন্দ্রগুলোকে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়েছে সরকার। ২০১৩-১৪ অর্থবছর থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত বেসরকারি বিদ্যুত্ ব্যবসায়ীদেরকে ৬১ হাজার ৪৬২ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হয়েছে। এ পরিমাণ অর্থ দিয়ে দুটি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা যায়। এদিকে গত ১০ বছরে সরকার বিদ্যুত্ খাতে অন্তত ৫২ হাজার ২৬০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে। অন্যদিকে গ্রাহক যে দামে বিদ্যুত্ কেনে, তা প্রকৃত উত্পাদিত মূল্যের চেয়ে বেশি নয়। তার মানে ভর্তুকির টাকা বেসরকারি খাতের বসে থাকা কেন্দ্রগুলোর পেছনে ব্যয় হয়েছে। এর মাধ্যমে খালি হচ্ছে রাষ্ট্রের কোষাগার। যা বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে সামাল দিচ্ছে সরকার। শূন্য হচ্ছে জনগণের পকেট। সর্বশেষ গত মার্চে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে।